স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকদূর এগিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির বিকাশ সাধনে কয়েকটি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেসব নিয়েই সম্প্রতি আমরা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার তথা পিপিআরসির পক্ষ থেকে "আ লুক অ্যাট বাংলাদেশ'স ৫০ ইয়ার জার্নি : টার্নিং পয়েন্টস অব দ্য ইকোনমি" শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজন করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমরা দেখেছি আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে কৃষি খাত, বেসরকারি খাত, রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু আমরা এটিও দেখেছি- অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনাগুলো কীভাবে উল্টোপথে যাচ্ছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুব বেশি এগোতে পারিনি। সুশাসনের অভাব এবং দুর্নীতি এখনও আমাদের বড় বাধা। এখানে আমরা বিশেষত কৃষি ও বেসরকারি খাত- এ দুটি বিষয় দেখব।
বলা বাহুল্য, দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন মানুষ কৃষি উৎপাদন করত নিজের পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য; এবং নিজের উদ্যোগে। তখন একফসলি ধান হতো। কৃষিতে তেমন আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার হতো না। গ্রামে লাঙলের প্রচলন ছিল। সেচ ব্যবস্থাও ছিল পুরোনো। এরপর ধীরে ধীরে কৃষিতে আধুনিকায়ন শুরু হয়। আশির দশকে এক প্রকারের সেচ পাম্প আমদানি করা হয়। তখন এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আমরা দেখি। নব্বইয়ের দশকে এসে সেই নিয়ন্ত্রণও কমে আসে।
ধীরে ধীরে কৃষি আধুনিকায়ন হয়। নানা যন্ত্রপাতি কৃষিতে সংযোজিত হয়। কৃষির উৎপাদন বাড়ে। কিন্তু কৃষির আধুনিকায়ন হলেও কৃষকের অবস্থার উন্নতি সেই তুলনায় হয়নি। বরং সৃষ্টি হয় মধ্যস্বত্বভোগীর। চালের মাধ্যমে যেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট। এখানে চালকল মালিকের উদ্ভব ঘটে। অন্য ক্ষেত্রে আসে আড়তদার। কৃষির যখন বাণিজ্যিকীকরণ ঘটল, তখন এই মধ্যস্বত্বভোগীরও উদ্ভব ঘটে। আমরা দেখেছি, কৃষির সম্প্রসারণ ঘটেছে, শস্যের বহুমুখীকরণ হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা যখন বেড়েছে আড়াই গুণ; তখন একই সঙ্গে আমাদের কৃষির উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।
কৃষির সম্প্রসারণে যেভাবে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেটি আমরা দেখিনি। তবে হ্যাঁ, গ্রামীণ অবকাঠামো বিশেষ করে সড়কে যে বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে কৃষক উপকৃত হয়েছেন। বিশেষ করে কৃষকের যখন কৃষিপণ্য বাজারে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ল, তখন ওই সড়ক ব্যবহার করে কৃষক বাজারে সহজে যেতে সক্ষম হন।
আমাদের কৃষির যে উৎপাদন বেড়েছে। যেভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে, তাতে আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদান স্বীকার করতেই হবে; উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন, কম জমিতে বেশি ফল নিশ্চিতকরণে কৃষিবিজ্ঞানের নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি সমকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, 'সবজি রপ্তানি বেড়ে এক দশকে ৪ গুণ'। সবজির চাষ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদানও কম নয়। বিশেষ করে দেশে যে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদন হচ্ছে তার অধিকাংশই দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের বীজ থেকে এসেছে। কিন্তু এখানেও সবজির উৎপাদনকারী কৃষক অনেক ক্ষেত্রেই এর সুফল পাচ্ছেন না। তাদের লাভের মধু খায় ফড়িয়া।
অথচ কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমেই দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি চলমান করোনা দুর্যোগেও কৃষক তার দায়িত্ব পালন করেছেন বলেই আজ খাদ্য সংকট থেকে দেশ বেঁচে গেছে। আমরা জানি, জাতীয় উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা এসডিজি অর্জনে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারই অংশ হিসেবে দেশের মানুষের পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের যে জোগান প্রয়োজন, সেখানেও কৃষক অবদান রাখছেন। সুষম খাবারের নিশ্চয়তা বিধানে মৎস্যে আমাদের উৎপাদন নজরকাড়া। আমরা দেখেছি, বিশ্বে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে। একই সঙ্গে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। এমনকি পেঁয়াজের যে সংকট ছিল সেখানেও আশা দেখাচ্ছেন কৃষকরা।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কৃষকের নিজের ভাগ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। এমনকি কৃষকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও লক্ষণীয় নয়। কৃষককে শুরু থেকেই যে চোখে সবাই দেখে আসছে, এখনও একই চোখে দেখে। অথচ কৃষি দিয়ে আমাদের আরও বিপ্লব করা অসম্ভব ছিল না। এমনকি কৃষিকে এখনও আমরা জাতীয় প্রবৃদ্ধির আলোচনায় সেভাবে আনতে পারিনি।
কৃষির পাশাপাশি আমাদের বেসরকারি খাতের বিকাশও লক্ষণীয়। বেসরকারি খাতকে আমরা মোটা দাগে দু'ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হলো, রাষ্ট্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারি খাত। আর অন্যটি নিজেদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা বেসরকারি খাত। বেসরকারি খাতের পরিধি কিন্তু অনেক বড়। এখানে যেমন বড় শিল্পকারখানা রয়েছে, তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাও অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারি খাত বেশিরভাগই বলা চলে দলীয় ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রিত। সেখানে মুষ্টিমেয় মানুষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন কিংবা অনেক ক্ষেত্রে তারাই কিছু পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তারাই সরকারি ঋণের অধিকাংশ নিয়ে নেন।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন শুরুর দিকে বলা চলে অর্থনীতি ছিল রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। তখন সেভাবে বেসরকারি খাত বিকাশ লাভ করেনি। ধীরে ধীরে ছোট ছোট উদ্যোগ আসে। আশির দশকে গার্মেন্ট শিল্পের সূচনা হয়। এরপর থেকে পোশাক শিল্পের প্রসার ঘটে এবং আস্তে আস্তে একটি শক্ত অবস্থানে চলে যায়। একই সঙ্গে আমরা ব্যাংক ব্যবস্থার বিকাশ দেখি। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংক।
গত এক দশকে বেসরকারি খাতের সুযোগ-সুবিধা, বিকাশ ও সম্ভাবনা যতটা বেড়েছে, একই সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। নিজ সক্ষমতায় বেড়ে ওঠা বেসরকারি খাত যেভাবে সংগ্রাম করে এগিয়েছে, আমাদের বেসরকারি খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তাদের আমরা কতটুকু জায়গা দিচ্ছি, তার ওপর। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের কথা বলতেই হবে। আমরা যদি সংসদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখছি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যের ১৮২ জন তথা ৬১ দশমিক ৭ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী। তাদের কেউ কেউ ব্যাংকেরও মালিক। এভাবে অন্যান্য নীতির জায়গায়ও যখন ব্যবসায়ীরা পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন তারা প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করবেন। নিজেদের স্বার্থে আইন প্রণয়নসহ অন্যান্য নীতি গ্রহণ করা হলে সেখানে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
বেসরকারি খাতে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে তা যদি রাজনৈতিক প্রভাবে একপক্ষীয় হয়ে যায়, সেখানেই সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। একদিকে কৃষিতে কৃষক বঞ্চিত, অন্যদিকে বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণও যাচ্ছে একশ্রেণির প্রভাবশালীর হাতে। কৃষি ও বেসরকারি খাত আমাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে এলেও এ দুটি বিষয় এখনও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চেয়ারপারসন, ব্র্যাক ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা