আবাসিক হল খোলা ও পরীক্ষার দাবিতে কয়েকদিন ধরে চলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অযৌক্তিক হিসেবে দেখার সুযোগ রয়েছে সামান্যই। বরং প্রশাসন যথাসময়ে যথোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা জানি, করোনা-দুর্যোগের কারণে প্রায় এক বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সব কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে এলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বারবার বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) নতুন বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিসহ অন্যান্য চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই বিশেষত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবাসিক হল না খোলায় স্বাভাবিকভাবেই ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। আমরাও তখন এ সম্পাদকীয় স্তম্ভে তাদের সমর্থন জানিয়ে বলেছিলাম, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গ্রামে অবস্থান করছে; যাদের অধিকাংশেরই আবাসিক হল ছাড়া শহরে এসে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকার মতো আবসিক ব্যবস্থা কিংবা সামর্থ্য কোনোটাই নেই। এমতাবস্থায় আবাসিক হল খুলে না দিলে এসব শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসে কীভাবে সশরীরে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে?' তারপরও শিক্ষার্থীরা হলের বাইরে থেকেই ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ইতোমধ্যে সরকারও পরিস্থিতির আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করে।

অনেকেই ভেবেছিলেন ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। এমনকি আমরা দেখেছি, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল খোলার ব্যাপারে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় মার্চ মাসে হল খোলার তারিখও ঘোষণা করে। যদিও শিক্ষার্থীদের হল খোলার আন্দোলন চলতে থাকে এবং গত কয়েক দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলের তালা ভেঙে হলগুলোতে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে দ্রুত হলগুলো খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দেন, মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল খুলে দেওয়া হবে এবং চতুর্থ সপ্তাহ থেকে ক্লাসসহ নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। শিক্ষামন্ত্রীর ওই ঘোষণার পরই অযৌক্তিকভাবে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নেওয়া স্থগিত করেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা এখন একই সঙ্গে হল খোলা ও পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছে। ইতোমধ্যে আন্দোলনের মুখে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরাও একই দাবিতে এবার মাঠে নেমেছে।

বৃহস্পতিবারও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে; পরীক্ষার স্থগিতাদেশ বাতিল না করলে তারা কঠোর আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দেয়। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আবাসিক হল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করেছে। যেখানে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সব কার্যক্রম শুরু হওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেখানে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরীক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করার যৌক্তিকতা কী? আমরা প্রত্যাশা করি, শিক্ষা প্রশাসন এভাবে হঠাৎ শিক্ষার্থী-বৈরী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রশাসনের সিদ্ধান্তে কেবল শিক্ষার্থীরাই বিভ্রান্তি ও ভোগান্তিতে পড়ছে না; একই শিক্ষার্থীর পরিবারও বিপাকে পড়ছে। অনেক শিক্ষার্থী কিছুদিন আগে হয়তো পরীক্ষার জন্য গ্রাম থেকে এসেছে, এখন হঠাৎ সিদ্ধান্তে তাদের আবার ফিরে যেতে হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষা যেহেতু শুরু হয়েছে, তা স্থগিতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যেহেতু স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য যথেষ্ট পরিপকস্ফ, তাদের আবাসিক হল খুলে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা জরুরি। তাদের পাশাপাশি অন্যান্য পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও দ্রুত খুলে দেওয়ার কথা প্রশাসন ভাবতে পারে। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা আরও গুরুতর করে তোলা উচিত হবে না।