- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বঙ্গবন্ধুর পোশাকেই বাঙালিয়ানার 'স্টেটমেন্ট'
বঙ্গবন্ধুর পোশাকেই বাঙালিয়ানার 'স্টেটমেন্ট'

বাঙালি নারীর সর্বজনীন পোশাক যে শাড়ি- সে ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু বাঙালি পুরুষের সর্বজনীন পোশাক কী- এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক দেখা যায়। আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর পোশাকই হতে পারে বাঙালি পুরুষের আনুষ্ঠানিক 'ড্রেস কোড'। বাইরের জন্য কেবল নয়, ঘরেও বঙ্গবন্ধু যা পরতেন, সেখানে দেশীয় আবহ স্পষ্ট। তার পোশাকই যেন ছিল বাঙালিয়ানার 'স্টেটমেন্ট'।
আমরা যখন বেড়ে উঠি, সেই ষাটের দশকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পোশাক এবং ফ্যাশন সচেতনতা ও স্বাতন্ত্র্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী শেখ মুজিবকে যে কোনো পোশাকই মানাত। এখনও বিভিন্ন আলোকচিত্রে আমরা দেখি, বিদেশ সফরে গিয়ে তিনি স্যুট বা ম্যান্ডারিন কলার কোট পরেছেন। আবার বাসায় আটপৌরে লুঙ্গি ও হাফ হাতা গেঞ্জি পরা ছবিও দেখা যায়। সবকিছু ছাপিয়ে তার নিজস্ব স্টাইল তৈরি হয়েছে সেই ষাটের দশকেই- সাদা রঙের ঢোলা পাজামা, খাটো ঝুলের পাঞ্জাবি ও হাতাকাটা কালো কোট। এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে ব্যাকব্রাশ করা চুল ও মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। বঙ্গবন্ধুর ফ্যাশন সচেতনতা বোঝার জন্য তার একই ফ্রেমের চশমা ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
খাটো ঝুলের পাঞ্জাবি বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক অনেক নেতাই পরেছেন। ঢোলা পাঞ্জাবিও তখনকার প্রচলিত স্টাইল। হাতাকাটা কোট পরাও উপমহাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিরল ছিল না। কিন্তু এই তিন পোশাক মিলে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করার ব্যাপারটি আর কারও মধ্যে নেই। আমরা দেখি, হাতাকাটা কালো কোটের নামই হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর নামে- 'মুজিব কোট'। এমন উদাহরণ আর কোথাও আছে? তার চেয়েও বড় ব্যাপার, পোশাকের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু যে রাজনৈতিক তাৎপর্য তৈরি করেছিলেন, তার তুলনা বাংলাদেশ ও উপমহাদেশ তো বটেই, বিশ্বের কোথাও নেই। যেমন ছয় দফা আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে মুজিব কোটে রয়েছে ছয়টি বোতাম। এটা কি অদ্বিতীয় এক রাজনৈতিক বিবৃতি নয়?
বঙ্গবন্ধুর পোশাকের আরও তাৎপর্য অনেকের চোখ এড়িয়ে যায়। তিনি সবসময় সুতি কাপড়ের পোশাক পরেছেন। আমরা অনেক রাজনৈতিক নেতাকে দেখি, বিদেশি দামি কাপড়ের পোশাক ছাড়া পরেন না। কিন্তু সুতি কাপড়ের পোশাকের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু আপামর বাঙালির সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের জল-হাওয়ার সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছেন। আবার এর মধ্য দিয়ে দেশের তাঁতি ও বস্ত্রশিল্পীদের অবদানও তিনি মনে রেখেছেন। আমরা সবাই যদি বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে সুতি কাপড় পরতে থাকি, তাহলে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য ও শিল্প আবার প্রাণ ফিরে পাবে।
বঙ্গবন্ধুর অনেক আলোকচিত্র পাওয়া যাবে, যেখানে তিনি লুঙ্গি পরেছেন। তার মানে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের পোশাকও ছিল তার একান্ত আপন। সেই লুঙ্গি নিয়েও কিছু কথা আছে। তার লুঙ্গি পরা ছবিগুলো আমি পরীক্ষা করে দেখেছি; প্রায় সবক'টিতে তিনি চেক লুঙ্গি পরেছেন। এর মধ্য দিয়েও তার নিজস্বতা বোঝা যায়। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা যদি বঙ্গবন্ধুর মতো লুঙ্গি পরায় অভ্যস্ত হতেন, তাহলে আমাদের লুঙ্গি শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যেত।
একই কথা বলা চলে গামছা নিয়ে। আমরা আজকাল দেখি, অনেকে 'বড়লোকি ভাব' দেখানোর জন্য তোয়ালে ব্যবহার করেন। বিশেষ করে সরকারি দপ্তরগুলোতে আমি দেখি তোয়ালের ছড়াছড়ি। অথচ আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং গামছা ব্যবহার করতেন। বস্ত্র ও হস্তশিল্প বিষয়ে আমার যে সামান্য অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাতে আমি নির্দি্বধায় বলতে পারি, আমাদের গামছার মতো চমৎকার বস্ত্র বিশ্বে আর নেই। গামছার 'ব্র্যান্ডিং' করতে গিয়ে দেখেছি, ইউরোপ-আমেরিকাতেও এর কত কদর! ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের সবাই যদি বঙ্গবন্ধুর মতো গামছা ব্যবহার করতেন, তাহলে আজ গামছা শিল্প আরও অনেক দূর এগিয়ে যেত।
তার মানে বঙ্গবন্ধুর পোশাক যেমন বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব করে; তেমনি এর মধ্যে রয়েছে আমাদের দেশীয় তাঁত ও বস্ত্রশিল্পের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ইশারা। এই মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিষয়টি সবাইকে ভাবতে বলি।
আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্যক্তিত্ব; জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত
মন্তব্য করুন