সব ধর্মেই মানুষকে হিংসাশ্রয়ী কিংবা ধ্বংসাত্মক পথ পরিহার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিস্মিত না হয়ে পারি না, যখন ধর্মের নামেই গুজব রটিয়ে আমাদের সমাজে নানা রকম দুস্কর্ম সংঘটিত হয়েছে, হচ্ছে। সর্বশেষ এমন ঘটনা ঘটেছে ৫ এপ্রিল রাতে ফরিদপুরের সালথা উপজেলায়। গুজবের জের ধরে প্রায় তিন ঘণ্টার তাণ্ডবে সালথায় ক্ষতের গভীরতা দগদগ করছে। শান্তিপ্রিয় মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার ভাঁজ পড়া মুখায়ব-কপালে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আতঙ্কের ছাপ। ক'জন যুবককে সরকারি কর্মচারীর লাঠিপেটার ঘটনা নিয়ে পুলিশের গুলিতে কয়েকজনের মৃত্যু এবং জনৈক মাওলানাকে গ্রেপ্তারের গুজবে ফরিদপুরের সালথায় যে ঘটনা ঘটে গেল, তা পূর্বতন ঘটনাগুলোরই ধারাবাহিক বলা যায়।
সালথায় সরকারি অফিস-কর্মকর্তাদের বাসভবন-যানবাহনে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ফলে ক্ষতের পাশাপাশি বাতাসে ভাসছে পোড়া গন্ধ। ঘটেছে হতাহতের মর্মন্তুদ ঘটনাও। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, স্থানীয় কয়েকটি মসজিদের মাইকে এবং ফেসবুক লাইভে গুজব ছড়িয়ে হাজার হাজার মাদ্রাসাছাত্র ও জনতাকে জড়ো করা হয় সালথা উপজেলা চত্বরে। তারপর পর্যায়ক্রমে চলে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। চলমান করোনা সংকট মোকাবিলায় সরকারি বিধিনিষেধের কার্যকারিতা পরিদর্শনে যান সালথার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান। স্থানীয় কয়েকজনের অভিযোগ, এ সময় তার গাড়ি থেকে তিন-চারজন লোক নেমে লাঠিপেটা করেন কয়েকজনকে। মুহূর্তেই চক্রান্ত গুজবাশ্রিত হয়ে শেষ হয় ভয়াবহতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। কুচক্রী-স্বার্থান্বেষী-হীনমন্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও পবিত্র মসজিদ ব্যবহার করে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল কারোরই এসব ক্ষেত্রে 'নিয়ন্ত্রণমূলক' ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো নজির আজ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক হয়ে ওঠেনি। মানুষ নামধারী কতিপয় উগ্রবাদীর চিন্তার জগতে অনেক ক্ষেত্রেই জেঁকে বসেছে অসত্যের গাঢ় অন্ধকার।
ইবাদত কিংবা উপাসনাক্ষেত্রকে যারা চক্রান্ত-গুজবের ঘাঁটি বানাতে চায়, তারা ধর্ম তো বটেই; মানবতা-সভ্যতা-দেশ-জাতিরও ঘোরতর শত্রু। এই শত্রুরা ইদানীং কেন সক্রিয় হয়ে উঠেছে; এর অনুসন্ধানে সরকার ও প্রশাসনকে উৎসে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে আত্মসমালোচনাও জরুরি। দৃষ্টান্ত দাঁড় করাতে না পারলে উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতিতে ঘোলা জল স্বচ্ছ হবে না। ফের সেই পুরোনো প্রশ্ন- গুজব রটনাকারী কারা? রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে গুজবের শিকড় কতটা গভীরে প্রোথিত এর অনেক নজির আমাদের সামনে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াত নেতা সাঈদীকে 'চাঁদে দেখা গেছে'- এ গুজব ছড়িয়ে বগুড়া কীভাবে রক্তাক্ত ও বিপর্যয়কর হয়ে উঠেছিল, তা অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে। ভোলা ও কক্সবাজারের রামুতে গুজব ছড়িয়ে বৌদ্ধমন্দির ও বসতিতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের ভয়াবহতা হয়তো অনেকেরই মানসপটে রয়ে গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা-তাণ্ডবের ঘটনাও অনেকের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও আছে এবং উল্লিখিত কোনো ঘটনাই দূর অতীতের নয়। অধিকাংশ ঘটনার সূত্রপাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক থেকে। অস্বীকার করার জো নেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনেক অবদান রয়েছে। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ হলো, এর অপব্যবহারও চলছে সমান্তরালে। ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিস্তৃত হওয়ার পর নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ অনেক বেড়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতায় এবং আশঙ্কা সেখানেই।
সচেতন মানুষমাত্রেই জানা, গণতন্ত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত। এককভাবে কিংবা গণজমায়েত আকারে দাবি জানানোর সুযোগও রয়েছে। সাংবাদমাধ্যমের রয়েছে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ। কিন্তু মতপ্রকাশ করতে গিয়ে প্রায়ই ব্যক্তি কিংবা মহলবিশেষ যে বিকৃত ও অসত্য তথ্য ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতা-নৈরাজ্যের জন্ম দিচ্ছে, তা আইনের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। এ রকম অপরাধের দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার একমাত্র প্রতিবিধান হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রশক্তি সেই প্রতিকার নিশ্চিত করতে পারছে না। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, গণমানুষের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে ইতোমধ্যে নানা মাধ্যমে কথাবার্তা কম হয়নি। কিন্তু ফল কী- এ প্রশ্ন দাঁড়ায়। গুজবের গুবরে পোকার কেন বিনাশ ঘটানো যাচ্ছে না- এ প্রশ্নের উত্তরও নিহিত এই জিজ্ঞাসার মাঝেই। আমাদের দেশে রাজনীতির বিপুল অর্জনের বিসর্জন ঘটেছে নানাভাবে। এর মধ্যে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির তীর এখন নতুন করে নানাদিকে ছুটতে শুরু করেছে।
যতদূর জানি, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিকট-অতীতে গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। একই অধিদপ্তরে একটি সেলও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এই কমিটি কিংবা সেলের দায়িত্বশীলরা কী করছেন- প্রশ্ন এও। সচেতন মানুষমাত্রেই জানা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুজবকে 'কৌশল' হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মনে রাখা দরকার, শুধু নদনদীর জলই লোকালয় ডোবায় না; বেনো জলের তোড়েও ভেসে যায় সহায়-সম্পদ। 'দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি'- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কাব্য-পঙ্‌ক্তির সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের অমিল খুঁজে পাওয়া ভার।
গুজব কীভাবে সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট ও জীবন-সম্পদহানির কারণ হতে পারে, এর নজির স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে অনেক পুষ্ট। গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রাজনৈতিক হট্টগোলের সৃষ্টি সুদূর অতীতেও হয়েছে। কিন্তু হাল আমলের মতো গুজবের পোকার এত বিস্তার ঘটেনি কখনও। গুজব প্রতিরোধে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি; সামাজিক-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সক্রিয়তা; পরিবার ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমের যূথবদ্ধ প্রয়াস আরও জোরদার না করলে সর্বনাশের পথ রুদ্ধ করা যাবে না। একই সঙ্গে জরুরি হলো যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচর্চার বহুমুখী পথ সৃষ্টি করা। দরকার যৌক্তিক তর্ক-বিতর্কের খোলা জানালা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে গুজবের পোকা এভাবে আগুন লাগাতেই থাকবে, আর সরকার-প্রশাসন এর দৃষ্টান্তযোগ্য কোনো প্রতিকারই করতে পারবে না- তা তো হতে পারে না। এও সত্য, সব গুজবের জন্মরহস্যও এক রকম নয়। তবে গুজবের জন্ম যেভাবেই হোক, তা শুধু অন্ধবিশ্বাসের বীজতলাই তৈরি করে; ডেকে আনে সর্বনাশ। পদ্মা সেতুতে নরবলির গুজব কল্পকথাকেও হার মানিয়েছিল এবং এ ক্ষেত্রেও অন্ধবিশ্বাসই ছিল মূল নিয়ামক।
গুজব-হিংস্রতা দুইয়েরই কঠোরভাবে মোকাবিলা করা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। গুজবের দাবানল ফরিদপুরের সালথায় যে ক্ষত সৃষ্টি করল, এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনের দায়ও কম নয়। যাদের ব্যর্থতায় অন্ধকারের বিস্তার ঘটছে, তাদের দায়হীন থাকার অবকাশ নেই। তারপরও বলি- দূর হ অন্ধকার। দূর হ পৈশাচিকতা-বর্বরতা। দূর হ কূপমণ্ডূকতা। চাই আলোকিত-বিকশিত মানুষ। গুজবের দাবানলে উত্তাপ বাড়ে। অন্ধকার দূর হয় না। আলোকিত মানুষের সংখ্যা না বাড়লে কাঙ্ক্ষিত আলোকিত সমাজ গড়ে উঠবে কীভাবে?
সাংবাদিক ও লেখক
deba_bishnu@yahoo.com