
গত পহেলা এপ্রিল ২০২১ সমকালে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল, 'আট বছর পর সচল হচ্ছে হেফাজতের ৬০ মামলা'। কার্যত এসব মামলা এতকাল ধরে 'ডিপ ফ্রিজে' ছিল। নানা ইস্যুতে হেফাজতের ব্যাপারে নীতিনির্ধারণী মহলের নমনীয় নীতির কারণে দীর্ঘদিন মামলাগুলোর তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। গত এক মাস ধরে আবারও আলোচনায় হেফাজত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসাকে কেন্দ্র করে ২৬ থেকে ২৮ মার্চ ধারাবাহিকভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে হেফাজত। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন ঢাকায় নামেন, তখন বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজের পর তাদের ওপর আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের হামলা হয় বলে হেফাজত দাবি করে। একপর্যায়ে পুলিশের আক্রমণের শিকার হন তারা। সেখানে তাদের লক্ষ্য করে ১১০০ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। এর পরপরই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে হাটহাজারী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সব মিলিয়ে ১৭ জন হেফাজত কর্মী প্রাণ হারান।
হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন পোড়ানো, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, জেলা পরিষদ কার্যালয় ও ডাকবাংলো, খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা ভবন, আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন, আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরসহ ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়। আর হাটহাজারীতে ভূমি অফিসে হামলা, হাটহাজারী থানায় হামলা, পুলিশের কাজে বাধা, পুলিশ সদস্যদের মারধর এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ওঠে।
এসব ঘটনায় হেফাজতের বিরুদ্ধে মামলা হয় ১৪০টি আর তাতে এ পর্যন্ত ৮ শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে ২০০ জনের মতো এজাহার নামীয় আর বাকি সব অজ্ঞাতনামা। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা পুলিশের একটা পুরোনো চর্চা। আর মামলা যদি হয় রাজনৈতিক, তাহলে তো কথাই নেই। একদিকে যেমন গ্রেপ্তারের নামে বাণিজ্য করা যায়, তেমনি বিরোধী দল-মতের নেতাকর্মী-সমর্থকদের যাকে যখন যেভাবে সুবিধা ভয়ভীতি দেখানো যায়, চাপে রাখা যায়, এলাকাছাড়া করা যায়, বাণিজ্য করা যায় এবং ওপর থেকে নির্দেশ পেলে যাকে খুশি তাকে গ্রেপ্তারও করা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া আমার নির্বাচনী এলাকা হওয়ার সুবাদে আমি জানি বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীকে মামলার ভয় দেখিয়ে এই রোজার মাসেও এলাকাছাড়া করা হয়েছে। বহু নেতাকর্মী আছেন যারা ঘটনার দিন এলাকাতেই ছিলেন না অথচ পুলিশ তাদের খুঁজছে। অর্থাৎ এসব অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা বিরোধী দল দমনের জন্য সরকারের একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
মজার বিষয় হলো, এই ঘটনার শুরুতে যখন মামলা হয়েছিল, তখন একটিতেও হেফাজতের কারও নাম ছিল না। হেফাজতের সর্বোচ্চ নেতাদের নাম আসতে শুরু করল যখন হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ব্যক্তিগত বিষয় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সংসদ পর্যন্ত আলোচিত হয়। এর পরে ধারাবাহিকভাবে শুরু হয় গ্রেপ্তার। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, মামুনুল হকসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে পুরোনো মামলায়।
এসব বিষয়ে গণমাধ্যম পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা জানান, তারা নাকি এতদিন তাকে খুঁজে পাননি। তেমনি পাননি মামুনুল হককেও। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, তাই না? এটাই এ দেশের আইনের শাসনের বাস্তবতা।
কথায় কথায় সরকার মনে করিয়ে দেয় আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু মুশকিল হলো, সেই গতি সরকার নির্ধারিত। কোনো মামলা আদৌ গতি পাবে কিনা, পেলে কখন কতটা গতি পাবে, সেটা নির্ভর করে সরকার কী চায় তার ওপর। এ কারণেই অতি আলোচিত সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার তারিখ নয় বছরে ৮০ বারের বেশি পেছায়। ত্বকী, তনু, মিতু কিংবা রিশা হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় না।
হেফাজতের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা চালু হলে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, 'এত বছর ধরে এসব মামলা মুলতবি রাখা যথার্থ হয়নি। এখানে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। দীর্ঘকাল মামলা ঝুলে থাকায় ওদেরও সাহস বেড়ে গেছে। বারবার সহিংস তাণ্ডব চালালেও তাদের কিছু হবে না- এরকম একটা ধারণা তাদের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে আছে। ফলে দ্রুত সুষ্ঠু তদন্ত করে মামলার চার্জশিট দাখিল করতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে না, তারা রেহাই পাবে।' ঘটনা ঘটলে মামলা হবে, পুলিশ তদন্ত করবে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে তাদের নাম আসবে এজাহারে, পরবর্তী সময়ে অধিকতর তদন্তেও যদি তাদের সংশ্নিষ্টতা পাওয়া যায়, তাহলে চার্জশিটেও তাদের নাম থাকবে। এরপর বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। এখানে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার বিষয়টি আসে কোথা থেকে?
নানা প্রসঙ্গে সরকার ২০১৩ সালে হেফাজতের তাণ্ডবের কথা বলে। মিডিয়ার মাধ্যমে এই দেশবাসীও সাক্ষী হয়েছে এসব ঘটনার। দেশের রাজধানীর একেবারে কেন্দ্রস্থলে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার তো বিচারই (উচ্চ আদালতসহ) শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল এই নয় বছরে। অথচ ৭৫ শতাংশ মামলার তদন্তই শেষ হয়নি এখনও। যেগুলোর চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিচারকাজও থমকে আছে নিম্ন আদালতে। মামলা না চলার কারণও স্পষ্ট। আর তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া তো একেবারেই সরকারের ব্যাপার।
এদেশে আইনের আসলে নিজস্ব কোনো গতি নেই। তাকে যখন যেখানে যেমন গতি দেওয়া হয়, সে তেমন গতিই পায়। আর তাই নুসরাতের মামলায় আমরা দেখেছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারকাজ নিষ্পন্ন হতে, কারণ সেখানে সরকারের ব্যবহার উপযোগী কোনো রাজনৈতিক উপাদান ছিল না এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাশালী কেউ সেই অপরাধে অভিযুক্ত ছিল না। কিন্তু হেফাজতের মামলা কিংবা এ ধরনের আরও বহু মামলা আমরা দেখি বছরের পর বছর আটকে থাকে। এ ধরনের মামলার নড়াচড়া শুরু হয় তখনই, যখন সরকার মনে করে এটাই সঠিক সময়।
বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ
মন্তব্য করুন