পবিত্র কোরআন নাজিলের মহিমান্বিত ও বরকতপূর্ণ মাস হলো রমজান। বারো মাসের মধ্যে রমজানের যে শ্রেষ্ঠত্ব, তা মূলত মহাগ্রন্থ আল কোরআনুল কারিমের জন্যই। কেননা, লাউহে মাহফুজ তথা সংরক্ষিত ফলক থেকে ধূলির ধরায় পবিত্র কোরআনের অবতরণ ঘটে এ মোবারক মাসেই। তাই কোরআনে পাকের সন্দেহাতীত শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে মাহে রমজান সংশ্নিষ্ট। পবিত্র কোরআনই আমাদের জানাচ্ছে- 'শাহরু রামাদানালাল্লাযি উনযিলা ফিহিল কুরআন হুদাল্লিন্নাস ওয়া বাইয়িনাতিম মিনাল হুদা ওয়াল ফোরকান।' অর্থাৎ, এ হলো সেই রমজান মাস, যাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে আল কোরআন; যা মানুষের জন্য পথনির্দেশিকা এবং এতে রয়েছে মানব জাতির হেদায়েত ও সত্য-মিথ্যা প্রভেদ করার অনবদ্য দলিল। অতঃপর সেই কোরআনুল কারিম কি দিনে নাকি রাতে অবতীর্ণ হয়েছে, সে বিষয়টিও কোরআন পাক আমাদের সুস্পষ্ট করেছে- 'ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিল কাদরি।' অর্থাৎ নিশ্চয়ই এই কোরআনকে আমি অবতীর্ণ করেছি এক মহিমান্বিত রজনীতে তথা লাইলাতুল কদরে, যা অনেকের মতে রমজানের শেষ ১০ দিনের কোনো এক বিজোড় রাত্রে হওয়ার কথা। তবে কেউ কেউ শবেকদরকে রমজানের ২৭তম রজনীতে সুনির্দিষ্ট করেছেন। এ রাতের মর্যাদাও সেই পবিত্র কোরআন নাজিলের কারণেই আর রমজান মাসের মর্যাদাও এ রাতের বিশিষ্টতারই ফলশ্রুতি। কোরআনুল কারিমে এ রাতকে হাজার মাসের চাইতেও উত্তম বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এতদ্ব্যতীত কোরআন নাজিলের কারণে এ রাতের আরও অনেক বৈশিষ্ট্য কোরআন-হাদিসে বিবৃত।
মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় হলো আল কোরআন, আর তা নাজিল হলো রমজান মাসে। আমাদের জন্য আশার কথা হলো, এ দুটি অমূল্য জিনিসই মুমিন বান্দার জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। মহানবী (সা.)-এর ভাষ্যমতে, রমজান বলবে, হে আল্লাহ! আমি এ বান্দাকে দিবাভাগে যাবতীয় পানাহার ও কামাচার থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। তাই এ বান্দার জন্য তুমি আমার শাফায়াত কবুল করো। একইভাবে পবিত্র কোরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমিই এ বান্দাকে রাত্রি জাগরণে বাধ্য করেছি, আরামের ঘুম বিনষ্ট করেছি। অতএব, এ বান্দার জন্য তুমি আমার সুপারিশ মঞ্জুর করো। অতঃপর বান্দার জন্য রমজান আর কোরআনের সম্মিলিত সুপারিশ মহান আল্লাহ কবুল করে নেবেন। তাই আমাদেরও উচিত পবিত্র রমজানে আল কোরআনকে অধিকতর তেলাওয়াত, বোঝা ও চর্চা করা। কেননা, পবিত্র কোরআনের মর্যাদার উপলব্ধির ওপরই রমজানের প্রকৃত অধিকারের মর্মার্থ অনুধাবন নির্ভরশীল।
মানবদেহের সঙ্গে পোশাকের যে সম্পর্ক; পবিত্র রমজানের সঙ্গে কোরআন পাকের সেই রকম নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। রমজান মাসে শুধু পবিত্র কোরআনই অবতীর্ণ হয়নি; পূর্ববর্তী অনেক আসমানি কিতাবও এই রমজানে নাজিল হয়েছে। রমজানের প্রথম রাতে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ওপর সহিফা নাজিল হয়। এমনিভাবে ষষ্ঠ রমজানে মশহুর পয়গম্বর হজরত মুসা কালিমুল্লাহ (আ.)-এর ওপর পবিত্র তাওরাত, ১৮ রমজানে হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর পবিত্র যাবুর এবং ১৩ রমজানে বিবি মারইয়াম-তনয় হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর পবিত্র ইঞ্জিল নাজিল হয়েছিল। সুতরাং আমরা দেখতে পাই, পবিত্র রমজানের সঙ্গে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে অন্যান্য আসমানি কিতাবেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা রমজানের মর্যাদাকে আরও অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ ও মহিমাময় করে তোলে। সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল-কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণে রমজানকে বিশেষভাবে 'কোরআনের মাস' হিসেবে অভিহিত করা হয়। বুখারি শরিফের হাদিসে রয়েছে, এ বরকতপূর্ণ মাসে রাসুলে আকরাম (সা.)-এর কাছে প্রতি রাতে হজরত জিব্রাইল (আ.) আগমন করতেন এবং তারা সমন্বিত রূপে পবিত্র কোরআনের 'দাওর' করতেন। অর্থাৎ কোরআনে কারিম থেকে একে অন্যকে শোনাতেন।
বরকতের রমজানে আবির্ভূত কালামে পাকের আলোকে আমরা জানতে পারি, সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য তাকওয়া তথা খোদাভীতি অর্জন। আল্লাহপাকের ঘোষণা- 'লাআল্লাকুম তাত্তাকুন।' অর্থাৎ রমজানের রোজাব্রত পালনের মধ্য দিয়ে হয়তো তোমরা পরিপূর্ণ মুত্তাকিরূপে নিজেদের গড়ে তুলতে পারবে। তাহলে এই রমজান পালন এবং কোরআনের নির্দেশনার আলোকে আমরা যদি তাকওয়া অবলম্বন করতে পারি; তার ফলে আমরা মধুর পরিণতি ভোগ করতে পারব। আল্লাহপাকের ঘোষণা- 'ওয়ালাও আন্না আহলাল কোরা আমানু ওয়াত্তাকাও লাফাতাহনা আলাইহিম বারাকাতিম মিনাস্‌ সামায়ি ওয়াল আরদ্‌।' অর্থাৎ জনপদের অধিবাসীরা যদি আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে ও তাকওয়া অবলম্বনে সক্ষম হয়, তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও জমিনের বরকতের সমস্ত ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেব। বস্তুত তখন আর আমাদের কোনো প্রকার অভাব-অভিযোগের লেশমাত্র থাকবে না। তাই কোরআন নাজিলের এই মাসে সিয়ামব্রত পালনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত তাকওয়া অবলম্বন করে নিজেরা এবং পুরো সমাজকে খোদাপ্রদত্ত বরকতের ভাণ্ডারে স্বাবলম্বী করার মহৎ প্রয়াসে সবাই শরিক হই। মহান আল্লাহপাক আমাদের সে তাওফিক দান করুন।
চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় : রমজান ও কোরআন

মন্তব্য করুন