করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের চলমান বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ঈদ উপলক্ষে মানুষ যেভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে জনস্বাস্থ্যে তার বহুবিধ বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। রোববারের সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে তাই 'আসছে ভয়ংকর বিপদ' শিরোনাম যথার্থ। আমরা জানি, করোনা সংক্রমণের লাগাম টানতে ঈদের ছুটি কমিয়ে দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ রেখে মানুষের গ্রামে যাওয়া নিরুৎসাহিত করেছিল সরকার। কিন্তু গত কয়েক দিনে যেভাবে 'বিকল্প' পথে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে গেছেন, তাতে সরকারের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা উভয়ই ভেঙে পড়েছে। শিমুলিয়া ঘাটের শনিবারের চিত্র আমরা দেখেছি, ফেরিতে উপচেপড়া মানুষের ভিড়। স্বাস্থ্যবিধি মানা কিংবা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বালাই নেই। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ তথা বিআইডব্লিউটিসি রোববার ভোর থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দিলেও মানুষের যাত্রা থেমে নেই। এমনকি বিজিবি মোতায়েন করেও মানুষকে আটকানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে। ভারতের এই ভয়ংকর বিপদ বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ার যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতে বাড়িফেরা মানুষের সঙ্গে দেশব্যাপী এ ধরনটি ছড়িয়ে পড়লে তা হবে ভয়াবহ। আমরা মনে করি, এবারের ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, তার পেছনে সরকারের ব্যবস্থাপনাগত বিভ্রান্তিও কম দায়ী নয়। আগামী ১৬ মে পর্যন্ত চলমান বিধিনিষেধের সময়সীমা বাড়ালেও পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের দাবির মুখে সরকার আন্তঃজেলায় পরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নিচ্ছে অনেকেই। বাড়তি ভাড়া দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরী থেকে মানুষ চলাচল করছে। এমনকি ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা শনিবার থেকে দেওয়া হলেও সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে মাওয়া, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে ভিড় করে হাজার হাজার ঘরমুখো মানুষ এবং জনচাপে ফেরি চলাচলে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে আবার দ্বিতীয় দফায় সরকার মত পরিবর্তন করে ফেরি বন্ধ রাখছে। বস্তুত মানুষের গ্রামে ফেরা ঠেকাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ যে যথাযথ হয়নি, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিছু চালু আর কিছু বন্ধ রেখে আরোপ করা বিধি কার্যকর করা যে অসম্ভব, তা ইতোমধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেছে। আন্তঃজেলা পরিবহন চালু করার ফলে মানুষ ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ পাচ্ছেন। তার চেয়ে বড় বিষয়, ব্যক্তিগত গাড়ি, পিকআপ, মাইক্রোবাস চলাচলে তেমন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ না করার ফলে সামর্থ্যবানরা সহজেই বাড়ি যেতে পারছেন। তার মানে কি এটা নয়, যাদের সামর্থ্য আছে, তারাই বাড়ি যেতে পারবেন? আমরা জানি, শহুরে মানুষের নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা ঈদের অন্যতম ঐতিহ্য, অবস্থার আলোকে এবারের মতোই গত ঈদুল ফিতরেও একই বিধিনিষেধ সবাই দেখেছে। আমরা চাই, সরকারের বিধিনিষেধ মানুষ মেনে চলুক। অন্তত নিজের ও পরিবারের সুরক্ষার জন্যই এটা জরুরি। সবাই যার যার মতো বাড়ি গেলে করোনা ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কষ্ট হবে। রোববার আমরা দেখছি, বন্ধ থাকা সত্ত্বেও হাজার হাজার মানুষ ফেরির জন্য অপেক্ষমাণ। ঝুঁকি নিয়ে এভাবে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মনে আছে, গত বছর পুলিশের চোখ এড়াতে রডবোঝাই ট্রাকের ওপর ত্রিপল ঢেকে বাড়ি যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু ঘটে। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতেও এবার বাড়ি না ফেরার মধ্যেই মঙ্গল। প্রধানমন্ত্রীও যার যার অবস্থানে এবারের ঈদ উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যথার্থ বলেছেন, 'ঈদের সময় মানুষ পাগল হয়ে গ্রামে ছুটছে। কিন্তু এই যে আপনারা একসঙ্গে যাচ্ছেন, এই চলার পথে ফেরিতে হোক, গাড়িতে হোক, যেখানে হোক- কার যে করোনাভাইরাস আছে আপনি জানেন না। কিন্তু আপনি সেটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আপনার পরিবারের কাছে।' ঈদযাত্রায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে প্রশাসনের তৎপরতার বিকল্প নেই। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই বিধিনিষেধ মানতেই হবে। তবে যাদের একান্তই বাড়ি যাওয়া জরুরি, তাদের জন্যও সুযোগ রাখা চাই।

বিষয় : ঝুঁকি নিয়ে ঈদযাত্রা

মন্তব্য করুন