অনেক ক্ষেত্রে অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে অনেক গর্ভবতী মা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। গর্ভকালীন সময়ে শতকরা ১০ ভাগ নারী উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতে পারেন। মূলত চার ধরনের উচ্চ রক্তচাপ এই ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে- দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ : শতকরা এক ভাগ অন্তঃসত্ত্বা নারী গর্ভধারণের আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিলেন; তিনি তা জানতেন বা জানতেন না। এই অবস্থায় গর্ভকালীন প্রথম ২০ সপ্তাহে উচ্চ রক্তচাপ নির্ণীত হলে তা ক্রনিক হাইপারটেনশন বলে ধরে নেওয়া হয়, গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ : অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ২০ সপ্তাহ পর হঠাৎ উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিলে তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। শতকরা পাঁচ থেকে ছয় ভাগ অন্তঃসত্ত্বা নারী এই ধরনের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হতে পারেন।

প্রি-একলাম্পশিয়া:উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নারী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ২০ সপ্তাহ পরে (সাধারণত শেষ তিন মাসে) উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে যদি প্রস্রাবে অ্যালবুমিন পাওয়া যায় (২৪ ঘণ্টায় ৩০০ মি. গ্রাম বা তার অধিক), তখন তিনি প্রি-একলাম্পশিয়ায় ভুগছেন বলে ধরে নেওয়া হয়। শতকরা তিন থেকে ছয় ভাগ নারী এই রোগে আক্রান্ত হন।

দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-একলাম্পশিয়া: দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ২০ সপ্তাহ থেকে প্রস্ট্রাবে যদি অ্যালবুমিন পাওয়া যায়। গর্ভকালীন অবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে মা এবং তার গর্ভের সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। সেজন্য গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে রক্তচাপ মাপাসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়মিতভাবে করা অত্যন্ত জরুরি। গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, বিশেষ করে প্রি-একলাম্পশিয়া একটি জটিল রোগ। প্রি-একলাম্পশিয়া সাধারণত গর্ভকালীন শেষ তিন মাসের মধ্যে দেখা দেয়। উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও মায়ের প্রস্রাবে তখন প্রচুর পরিমাণে অ্যালবুমিন পাওয়া যায়। প্রি-একলাম্পশিয়া হওয়ার আশঙ্কা বা ঝুঁকি যাদের বেশি, তারা হলেন- গর্ভবতীর বয়স ১৮ বছরের কম, গর্ভবতীর বয়স ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে, প্রথমবার গর্ভবতী হওয়া, অনেকবার গর্ভবতী হওয়া, আগে প্রি-একলাম্পশিয়া হয়েছিল, পরিবারের অন্য সদস্য যেমন মা-বোনের প্রি-একলাম্পশিয়া বা একলাম্পশিয়া হয়েছিল, অন্তঃসত্ত্বা মা উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিলেন, স্থূলাকার হলে অথবা হঠাৎ করে ওজন অত্যধিক বেড়ে গেলে।

প্রি-একলাম্পশিয়া হলে গর্ভবতীর শরীরের রক্তনালিগুলো সংকুচিত হয়ে আসে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে প্রদাহ দেখা দেয়। তখন বিভিন্ন অঙ্গ যেমন লিভার, কিডনি ও ব্রেনে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এই সময় রোগীর প্রধান উপসর্গগুলো হলো- মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, প্রস্রাব কম হওয়া, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিশেষ করে চোখ, মুখ, হাত-পা ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া উচ্চ রক্তচাপ দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না করলে রোগিণীর মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, ফুসফুসে পানি জমা, শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হওয়াসহ কিডনি ও লিভার অকার্যকর হতে পারে। জরায়ুর রক্তনালি সংকুচিত হওয়া ও উচ্চ রক্তচাপের কারণে গর্ভের সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। গর্ভের সন্তান স্বাভাবিকভাবে বড় হতে পারে না। এমনকি গর্ভাবস্থায় সন্তানের মৃত্যুও হতে পারে। প্রি-একলাম্পশিয়া সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে তা একলাম্পশিয়ায় রূপান্তরিত হতে পারে। একলাম্পশিয়া হলে গর্ভবতী অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং তার শরীরে অনবরত খিঁচুনি হতে থাকে। দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে মা ও তার গর্ভের সন্তান দুজনেরই মৃত্যু ঘটে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বে আনুমানিক ৫০ হাজার নারী একলাম্পশিয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। অথচ একটু সচেতন হলেই এই মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। সন্তান প্রসবের পরও একজন প্রি-একলাম্পশিয়া রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও একলাম্পশিয়ার খিঁঁচুনি হতে পারে। তবে আশার কথা হলো, অধিকাংশ মায়ের ক্ষেত্রে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে আসে। গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ গর্ভবতী ও তার গর্ভের সন্তানের জন্য একটি মারাত্মক বিপদ সংকেত। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতায় এই বিপদ থেকে আমরা মা ও সন্তানকে রক্ষা করতে পারি।

চিফ কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজিস্ট; অধ্যাপক, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট