সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে পবিত্র ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হলেও স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছেন। দূরপাল্লার যানবহন না চললেও বিকল্প পথে গ্রামমুখী মানুষের ঢল আমরা দেখেছি। করোনাদুর্যোগের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি কিংবা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা থাকলেও গ্রামে ফেরার পথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত ছিল। ঈদের আগে এ সম্পাদকীয় স্তম্ভে এ ব্যাপারে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। শুক্রবার ঈদ অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আবার শহরমুখী মানুষের ভিড় স্পষ্ট। রোববার সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, পদ্মার উভয় তীরের বাংলাবাজার ও শিমুলিয়া ঘাটেই যাত্রীর চাপ। প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকামুখী মানুষের ভিড় যেমন রয়েছে, তেমনি ঘরমুখী মানুষের যাত্রাও থেমে নেই। ফেরির সংখ্যা বাড়িয়েও যাত্রীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঘাট কর্তৃপক্ষ।

উদ্বেগের বিষয় হলো, গ্রামমুখী কিংবা ঢাকা ফেরত মানুষের সংবাদমাধ্যমের খবর কিংবা টিভি চ্যানেলের ফুটেজে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা কিংবা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। বরং দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা দেখেছি ঈদের এক দিন আগে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে দুই পৃথক ফেরিতে যাত্রীদের হুড়োহুড়িতে শিশুসহ পাঁচজন মারা যায়। অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়। তার অর্থ সতর্ক না হলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমনিতেই দুর্যোগের কারণে যেখানে সবার সহনশীল হওয়া উচিত ছিল, তা না করে অযথা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে প্রাণ হারানোর মতো ঘটনা ঘটেছে! এমন মর্মান্তিক অঘটনের পর থেকে অতিরিক্ত যাত্রী তোলার ব্যাপারে ফেরি কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর 'কড়া' নজর থাকার কথা বলা হলেও ফেরির ভিড় এখনও যেই সেই। স্বাস্থ্যবিধি এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা না মেনে এভাবে দলে দলে মানুষের শহরমুখী হওয়ার ফলে যেমন করোনাভাইরাসের বিস্তারের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা, তেমনি তার চেয়েও বড় বিষয়- বাংলাদেশে করোনার ভয়ংকর ভারতীয় ধরনের উপস্থিতি। সরকার ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলমান বিধিনিষেধ ২৩ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গ্রামে যাওয়া মানুষের ফিরতি যাত্রা বিলম্বিত করতে সুপারিশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সবার ফেরানোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখছি না। বিধিনিষেধ বাড়ানোর ফলে শহরমুখী স্রোত নিয়ন্ত্রণের ওপর কিছুটা প্রভাব পড়লেও অনেকেই যেভাবে এখনই আসা শুরু করেছে, তাতে কর্তৃপক্ষের সতর্কতার বিকল্প নেই। আমরা জানি, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হওয়ার পর দেশে নতুন করে আতঙ্ক বাড়ছে। এ ধরন খুব দ্রুত ছড়ানোর ফলে এবং একই সঙ্গে প্রাণঘাতী হওয়ায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই অধিক সতর্কতার ওপর জোর আরোপ করেছেন। বলাবাহুল্য, এবারে গ্রামমুখী কিংবা শহরমুখী মানুষের ঢল দেখতে নদীপথের ফেরির দৃশ্যই বেশি সামনে এসেছে। মনে রাখতে হবে, শহর ছেড়ে যারা গ্রামে যায় কিংবা শহরে ফেরত আসে, ফেরির পথ তার একটা অংশ। অন্যান্য পথে মানুষ কীভাবে আসা-যাওয়া করছে, সেখানেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর রাখা দরকার। কেবল করোনা সতর্কতার জন্যই নয় বরং নিরাপদে যাতে মানুষ কর্মস্থলে আসতে পারে, তাও নিশ্চিত করা চাই।

প্রায় প্রতি বছরই ঈদের সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে অনেকেই প্রাণ হারান। এবারের ঈদে দূরপাল্লার যান না চললেও সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হয়নি। ভাড়া মাইক্রোবাসে যাওয়ার সময় যেমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তেমনি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষেও মৃত্যুর ঘটনা থেমে ছিল না। করোনাদুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে যেমন আমাদের সতর্কতা প্রয়োজন, একই সঙ্গে সড়ক-মহাসড়ক যেভাবে মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠছে, সে দুর্যোগ থেকেও দীর্ঘমেয়াদে রেহাই পেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমরা জানি, ঈদ আনন্দের উপলক্ষ। আনন্দ যেন বেদনার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সেজন্য করোনার এ সময়ে সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। এখনও শহরফেরত যারা গ্রামে রয়েছেন, তাদের সবার একসঙ্গে কর্মস্থলে না এসে ধীরে ধীরে আসা উচিত। কেবল উৎসবে ঢাকা ছাড়া ও ফেরার পথে নয়, সব সময়ই সতর্ক থাকতে হবে।