- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ধর্মীয় উগ্রবাদে সমাজ পিছিয়ে যায়
ধর্মীয় উগ্রবাদে সমাজ পিছিয়ে যায়

পঁচাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশে ফিরিয়ে আনেন গোলাম আযমসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কুখ্যাত লোকদের। তিনি নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু হয় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে দেশজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দলীয় নেতাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হওয়ার পর জামায়াত কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। প্রকাশ্যে না থাকলেও থেমে নেই তাদের কর্মকাণ্ড। এ কাজে তারা ব্যবহার করছে মাহফিল, মসজিদ, মাদ্রাসা, ফেসবুক, ইউটিউব। আওয়ামী লীগ সমর্থক কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে ফেসবুকে কিছু পোস্ট দিলেও তা সমন্বয়ের অভাবে কুলাতে পারছে না জামায়াতের প্রচারণার কাছে। সরকার সাইবার ক্রাইম ইউনিট চালু করলেও দমাতে পারছে না ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে জামায়াত, হেফাজতের প্রপাগান্ডা।
চার দশক ধরে চলমান ধর্মের নামে উগ্রবাদিতার প্রচারে আমাদের সমাজ অনেকখানি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দিকে হেলে পড়েছে। চলতি হাওয়ায় তাল মেলাতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থশালী হওয়া লোকেরা পারলৌকিক অপরাধ লাঘবের আশায় জনগণের কাছ থেকে চুরি করা পয়সা হালাল করতে মাদ্রাসা বানিয়েছে। বিগত ১০-১২ বছরে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ছাড়া বিএনপির অন্য কোনো মোক্ষম কৌশল চোখে পড়ে না। বামপন্থিরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে করতে জামায়াতের প্রচারে বিলীন হয়ে গেছে। দেশে এখন ধর্ম ব্যবসা এমন পর্যায়ে যে, দেশি এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও এখানে ধর্ম ব্যবসা করছে। ধর্মের নামে পণ্য বিক্রি করছে।
দেশে যে সংখ্যক মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে, তাতে অন্যান্য ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরও উদ্ভব হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হেফাজতের কাছে; আলিয়া মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ জামায়াতের হাতে। বিগত চার দশকে যত মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসার চেয়ে কওমি মাদ্রাসাই বেশি। এসব মাদ্রাসা চলে বিত্তবানদের দান এবং মুসলিমবিশ্বের অর্থায়নে। কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ তেমন নেই বলে তারা ইচ্ছামতো কারিকুলাম তৈরি করে মাদ্রাসা চালায়। এই মাদ্রাসা তৈরি করা সহজ। আলিয়া মাদ্রাসায় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, জীবনযাপন সম্পর্কে কিছু আলোচনা থাকলেও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম এখনও আধুনিক হয়নি। তাদের অনেকে সমাজ, উৎপাদন, অর্থনীতি, রাজনীতি সম্পর্কে তেমন জ্ঞাত নন। এই মাদ্রাসা শিক্ষা জীবনমুখী নয় বলে কর্মমুখী হয়ে উঠতে পারেনি।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত শেখান না। স্কুলের মতো অ্যাসেম্বলি করে তারা জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন না। এরা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বোঝেন না, বঙ্গবন্ধুকে চেনেন না। রাষ্ট্র ও তার কার্যালয়কে তাদের অনেকে নিজের বলে ভাবতে পারেন না। বাংলাদেশ কী, কেন; কীভাবে এর সৃষ্টি; এর ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের অনেকেরই ধারণা নেই।
দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে এরা একটা বড় অংশ। শুধু ধর্মের নামে এমন একটা জনগোষ্ঠীকে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। এরা অন্যের স্বার্থে ব্যবহূত হয়। তাদের রাজনীতিতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই ধর্মীয় বিষয় সামনে এনে এদের উস্কে দেওয়া হয়। নারী নীতি, লালনের ভাস্কর্য, সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, ভারত-বিদ্বেষ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ইত্যাদি বিষয় সামনে এনে এদের ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত করা হয়। ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো গেলে দেশ অস্থিতিশীল করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুযোগ নেওয়া যায়। সে সুযোগ কাজে লাগাতে নেমে পড়ে সুযোগসন্ধানীরা। তারা হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞে সমর্থন দেয়, উৎসাহ দেয়; অর্থ সরবরাহ করে।
রাজনীতি বলতে উগ্রবাদীরা শুধু হত্যা, ধ্বংস, অরাজকতা বোঝে। এদের হাতে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিস্কার হয় না। প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্যের সৃষ্টি হয় না। এরা ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ, ঘৃণা, বিবাদ সৃষ্টি করে। পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায়, উগ্রবাদীরা সর্বত্র ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করে। শুধু বর্তমানে নয়; অতীতেও এরা ঘৃণা, বিদ্বেষ ছাড়া সৃষ্টিশীল কিছু করতে পারেনি। ধর্ম যেহেতু এখনও পৃথিবীর প্রায় সব দেশে প্রাধান্য নিয়ে আছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মপ্রাণ; তাই জনগণের মধ্যে ধর্মের মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারলে নিজেদের জন্য ভোটব্যাংক নিশ্চিত করা সহজ হয়। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার হলে সে সমাজ বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত হয়।
ধর্মান্ধরা এখানে খিলাফত কায়েমের কথা বলে। মধ্যপ্রাচ্যে আইএস খিলাফতের কথা বলেছে। অথচ খিলাফতের রাষ্ট্রীয় এবং অর্থনৈতিক কাঠামো কী হবে, সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত ধর্ম ব্যবসায়ীরা কোনো রূপরেখা দিতে পারেনি। বর্তমান পৃথিবী সম্পর্কে এদের কোনো ধারণা নেই। এরা বিশ্বব্যবস্থা দূরে থাক, নিজ দেশ কীভাবে চলে, সে বিষয়েই কোনো ধারণা রাখে না; জ্ঞানত নয়ই। এদের ধর্মীয় কথাবার্তায় অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ মনে করে, জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারলে পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে। কিন্তু কীভাবে সুন্দর হবে, কী কী করলে সুন্দর হবে- সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে এদের মুখে কোনো উত্তর জোটে না। এরা ক্ষমতা পেলে তা দিয়ে কী করবে- এ প্রশ্নের উত্তর নেই।
অনেকে এখানে খোলাফায়ে রাশেদিন আমলের উদাহরণ আনতে চাইতে পারেন। তাই বলে রাখি; সে সময় আরব শাসকরা ইউরোপ থেকে খ্রিষ্টান উগ্রবাদীদের হাতে বিতাড়িত বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী মানুষদের অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে ক্ল্যাসিক আমলের বইপত্র জোগাড় করে তা আরবিতে অনুবাদ করেছেন। যে জ্ঞানচর্চা করেছেন, সে জ্ঞানের বলে নিজেরাও নতুন নতুন সৃষ্টি করেছেন বলেই সে সময়টা ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সময় বলে গণ্য হয়। জামায়াত-হেফাজতের রাজনীতি আর খোলাফায়ে রাশেদিনের রাজনীতি এক নয়; সম্পূর্ণ আলাদা। খোলাফায়ে রাশেদিনের রাজনীতি ছিল সমন্বয়বাদী, গ্রহণবাদী। জামায়াত, হেফাজত, তালেবান, বিজেপি, ট্রাম্পের রাজনীতি বিভাজনবাদী, ধ্বংসাত্মক। কোনো সুস্থ বুদ্ধির মানুষ মনে করে না- ধর্মান্ধরা ক্ষমতা পেলে রাষ্ট্র চালাতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির স্থান নেই। তাই নিষিদ্ধ করতে হবে সব রকম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন।
হেফাজতকে শুধু রাজনীতি থেকে দূরে সরালেই চলবে না। এদের কর্মমুখী করে তুলতে হবে। হেফাজতের কওমি মাদ্রাসাসহ সব মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করতে হবে। মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকেও অবৈজ্ঞানিক বিষয়াদি দূর করতে হবে। একটা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এ কাজ সম্পাদন করতে হবে। এ জন্য এখনই একটা কমিশন গঠন করা দরকার। অন্যথায় পেছনে হাঁটতে শুরু করবে বাংলাদেশ। ২০৪১ সাল নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান, মর্যাদায় উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্টম্ন অধরাই থেকে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার- ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ধরে রাখা যাবে না।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
মন্তব্য করুন