ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নিয়ে আজও শ্রমজীবীর হাতেই হাত রাখেন রাশেদ খান মেনন। '৯২-এর ১৭ আগস্ট তোপখানায় পার্টি কার্যালয়ের সামনে অপশক্তির গুলিতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। জনগণের ভালোবাসায় ফিরেও এসেছেন। 'জীবন দখল করো এবং বিলিয়ে দাও'- এ ব্রত নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী মেনন ২৯ বছর ধরে লড়ছেন গণমানুষের সংগ্রামে। রাজনৈতিক অঙ্গনের জীবন্ত এই কিংবদন্তির আজ ৭৯তম জন্মদিন।
১৯৪৩ সালের এই দিনে মেনন জন্মগ্রহণ করেন বাবার কর্মস্থল ফরিদপুর শহরে। পিতৃভূমি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচরের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে। পিতা বিচারপতি আব্দুল জব্বার খান ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার। মা সালেহা খাতুন।
সুস্থ ধারার রাজনীতির আইকন রাশেদ খান মেনন বানের জলে ভেসে আসা নাম নয়। হঠাৎ জ্বলে ওঠা স্ম্ফুলিঙ্গও নন। লড়াই-সংগ্রামের এক পরীক্ষিত যোদ্ধা। ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এসেছিলেন আইয়ুববিরোধী সামরিক শাসন ও বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি ছিলেন '৬৩-৬৪ সালে। '৬৪-৬৭ সালে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। '৬২ সালে নিরাপত্তা আইনে প্রথম গ্রেপ্তারের পর '৬৯ সাল অবধি বিভিন্ন মেয়াদে কারাবরণ করেছেন। জেলে থাকাকালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। '৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ সংগ্রামে তার অনন্য ভূমিকা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে কুখ্যাত মোনায়েম খানের আগমনের বিরোধিতা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তিনি জেল থেকেই এমএ পরীক্ষা দেন। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মেনন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতিতে যোগ দেন।
২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যার পর কমরেড মেনন নরসিংদীর শিবপুরকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজ শুরু করেন। এর পর ভারতে গিয়ে সব বামপন্থি সংগঠন নিয়ে 'জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটি' গঠন করেন। দেশের অভ্যন্তরে নানা স্থানে কেন্দ্র করে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
স্বাধীনতার পর মেনন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। '৭৪ সালে ভাসানী ন্যাপ থেকে বেরিয়ে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি) গঠিত হলে তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। '৭৮ সালে ইউপিপি জেনারেল জিয়ার জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দিলে মেনন ইউপিপি ত্যাগ করে 'গণতান্ত্রিক আন্দোলন' গড়ে তোলেন। ওয়ার্কার্স পার্টি পুনঃসংগঠিত হলে তিনি সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে সম্মিলিত কৃষক সংগ্রাম পরিষদ এবং শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) গড়ে তোলায় অগ্রগামী ভূমিকা রাখেন। '৮৬ সালে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে বিরোধ সৃষ্টি হলে ওয়ার্কার্স পার্টিসহ পাঁচ বাম দল ১৫ দল থেকে বেরিয়ে পাঁচদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। এ সময় ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ঐক্যবদ্ধ হলে রাশেদ খান মেনন ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে তিন জোটের রূপরেখা ও ঘোষণা প্রণয়নে রাশেদ খান মেনন নেতৃত্বের কাতারে ছিলেন।
১৯৭৯ সাল থেকে পাঁচ দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন রাশেদ খান মেনন। সংসদে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক তৎপরতা, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কাছে সরকারের নতজানু নীতি, পাটশিল্পের ধ্বংস সাধন, মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে লুটপাটের আর্থনীতিক নীতি অনুসরণের দৃঢ় বিরোধিতা করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল, শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শ্রম অধ্যাদেশ বাতিল, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন ও মজুরির নিশ্চয়তা, জাতীয় শিল্প রক্ষা, তেল-গ্যাস ও শিল্পসম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ, নারী নীতি বাস্তবায়ন, পরিবেশ রক্ষা, প্রতিবন্ধীদের অধিকার, শিশু অধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথেও সোচ্চার থেকেছেন।
বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে ১১ দল এবং আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপসহ ১৪ দলীয় জোট গঠনে মেনন ছিলেন অগ্রগামী নেতা। ওয়ান-ইলেভেনেও সাহসী কণ্ঠস্বর ছিলেন রাশেদ খান মেনন। কারারুদ্ধ শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে তিনিই প্রথম সোচ্চার হন।
কমরেড মেনন ক্ষমতা নয়, জনতার সাথী। জাতির দুঃসময়ে এগিয়ে আসাই তার রাজনৈতিক আদর্শ। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিত্বের সুযোগ থাকার পরও সব সময় তা গ্রহণ করেননি। জিয়া ও এরশাদের মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় কমরেড মেনন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তার দায়িত্বকালেই বিমান প্রথম লাভের মুখ দেখে। পরে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
রাশেদ খান মেনন রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শ, লড়াই-সংগ্রামের জ্বলন্ত প্রদীপ। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের ভরসাস্থল। নতুন প্রজন্মের লড়াইয়ের প্রেরণা। তিনি আরও বহু বসন্ত থাকুন লড়াইয়ের ময়দানে সাহসী কণ্ঠস্বর হয়ে- এটাই প্রত্যাশা। তার জন্মদিনে জানাই রক্তিম শুভেচ্ছা।

সাবেক ছাত্রনেতা