- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ব্যক্তি উদ্যোগের যুগে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত
অর্থনীতি
ব্যক্তি উদ্যোগের যুগে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত

গত প্রায় ৩০ বছরে সরকারের বিভিন্ন নীতি-সহায়তা, উন্নয়ন সহযোগীদের কিছুটা দিকনির্দেশনা, বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের উদ্যম-উদ্দীপনায় গড়ে উঠেছে একটি বর্ধিষ্ণু ব্যক্তি খাত বা বেসরকারি খাত। এখন বোধ হয় বলা চলে- বাংলাদেশের অর্থনীতির চালকের আসনে রয়েছে ব্যক্তি খাত। সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত খাত বলতে গেলে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। এই সময়ে তাই একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কথা ভাবা অনেকটা জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার মতো। একই কারণে হয়তো আমরা টিসিবি, বিটিএমসি, অ্যাটলাস বা অন্য কোনো সংস্থাকে দিয়ে কিছুতেই বাজারে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারিনি। বিপিসির মতো প্রতিষ্ঠান এতদিন পরও নিয়মিত তার আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে না। বিমান নিয়মিত বিপিসিকেও তেলের দাম পরিশোধ করতে পারে না। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন যেন 'জন্ম থেকে জ্বলছে'। সর্বত্র যেন 'সরকারকা মাল দরিয়ামে ঢাল'। তাই অনেক দিন ধরে অনেকেই রব তুলছেন 'গভর্নমেন্ট শুড নট বি ইন বিজনেস' অর্থাৎ সরকারের উচিত নয় ব্যবসায়ে আসা। মনে পড়ে, ব্যবসায়ী নেতা মঞ্জুর এলাহী একবার বলেছিলেন- 'কোনো সহায়তা চাই না; দয়া করে আপনারা আমাদের নিজের মতো করে চলতে দিন।' আরও মনে পড়ে, ২০১৪ সালে এমসিসিআইর সঙ্গে এক বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ আমির হোসেন আমু বলেছিলেন- '১৯৭২ সালের বাস্তবতা এখন নেই। এখন সরকারের উচিত হবে স্থানীয় ব্যক্তি খাতকে সব সহায়তা দিয়ে বিশ্ববাজারের জন্য আরও প্রতিযোগিতাশীল করে তোলা।'
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্র্রতিক এমন এক নির্দেশনায় তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রত্যাশাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে। ৪ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি তথা একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যও যথার্থ যে ব্যাংক-বীমা, টেলিযোগাযোগ, পর্যটন খাতে সরকারি কোম্পানি বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় পরিচালিত হতে পারে না।
এটি অবশ্য অস্বীকারের সুযোগ নেই- নাগরিক সুবিধার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহনের মতো সেবা খাতগুলোতে সরকারের সহায়তা ও ভর্তুকি দেওয়া উচিত এবং অনেক দেশ দিচ্ছেও। উন্নত ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সেটাই সংগত। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান গঠনই করা হয় কোম্পানি হিসেবে এবং যেগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারে, তাদের বেলায়ও একই ব্যবস্থা চলবে কেন? শুধু কোম্পানিগুলো সচল বা কার্যকর রাখা নয়; প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজস্ব বিনিয়োগে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতাও গড়ে উঠতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ক্রমাগত আর্থিক ও বাণিজ্যিক সাফল্যই হওয়া উচিত সব বিবেচনার মাপকাঠি।
বাস্তবে আমরা অবশ্য উল্টো চিত্র দেখে থাকি। সরকারি পুঁজি, অবকাঠামো, ব্যবস্থাপনাগত সুযোগ এবং অনেক ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও যুগের পর যুগ রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি খাত হিসেবে এগুলো টিকে থাকে বা টিকিয়ে রাখা হয়। আমাদের 'ন্যাশনাল ব্যালান্সশিট' বা রাষ্ট্রীয় স্থিতিপত্রে বিরাট এবং অবিরাম রক্তক্ষরণেরও কারণ এসব সংস্থা।
এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কথা। আমাদের মনে আছে, করোনা পরিস্থিতির আগে খোদ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, মূলধন ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আর অর্থ দেবে না সরকার। কারণ, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো যে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, তার ভিত্তিতে তাদের বরং বাড়তি মুনাফা করা উচিত। মুনাফা দূরে থাক, প্রতি বছর ওইসব ব্যাংক লোকসানের পরিমাণ বাড়িয়েই যাচ্ছে। আর প্রতি বছর জাতীয় বাজেট বা কোষাগার থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এই বিরাট ব্যর্থতার গ্লানি বা লোকসান পূরণ করতে হয়। আমরা মনে করি, এভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বছর বছর রাষ্ট্রের অর্থ ঢালার মধ্য দিয়ে আসলে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবিশেষের অদক্ষতা ও ব্যর্থতার দায় গোটা জাতির ওপরে চাপানো হচ্ছে। এই প্রশ্ন তোলা হয়তো অন্যায্য হবে না কিংবা কেউ কেউ হয়তো ইতোমধ্যে তুলছেন- ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষকে সুবিধা দিতে সাধারণ নাগরিকরা এই লোকসানের বোঝা কত দিন বহন করে চলবে?
আমরা জানি, বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত বা কিছু উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত যে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিশ্চিত চাকরির কারণে উদ্যম ও উদ্ভাবনে আন্তরিক থাকেন না। তারা দক্ষতার বদলে দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। নিজস্ব আয় থেকে পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের প্রশ্ন যখন আসবে, তখন মুনাফা করা এমনকি সরকারকে রাজস্বের জোগান দেওয়ার ব্যবস্থাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন নিয়োগ, ছাঁটাই, ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনসহ প্রয়োজনীয় যে কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। আশার কথা, বিলম্বে হলেও এ ধারা সূচিত হওয়ার কিছুটা ধ্বনি শুনছি আমরা। অন্তত এই করোনাকালেও প্রধানমন্ত্রী যে এটি নিয়ে ভাবছেন, সেটিই বেশ সুখকর।
ইতোমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করেছে সরকার। অস্বীকার করা যাবে না যে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক করতে গেলে অনেক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়মিত কাজ হারায়। লোকসানের দুষ্টচক্র রোধ করতে হলে এর বিকল্পও নেই। অন্যদিকে আদমজী পাটকল বন্ধ করে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো বলেই প্রতীয়মান।
আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে লোকসানি হয়ে ওঠে না। দলাদলি, স্বজনপ্রীতি, কায়েমি স্বার্থও সমান দায়ী। অনিয়ম বন্ধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রশ্নেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের নিজের পায়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোও সংস্কার-অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আধুনিক উৎপাদন, সেবা ও বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে নতুন প্রযুক্তিও প্রয়োজন। ফলে সবকিছু ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি এগুলোর জনবল ও দক্ষতার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে চাইব রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে কর্মী সংগঠন, রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, এমনকি নাগরিক সমাজ ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লাভজনক হওয়ার নজির আমাদের পাশের দেশ ভারত, এমনকি অন্য অনেক সমপর্যায়ের দেশগুলোতেই রয়েছে।
সীমিত ভৌগোলিক পরিধিতে বিপুল জনগোষ্ঠী এবং ক্রমবর্ধমান ভোগব্যয়ের এই দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হতে পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পারবে না কেন? সে জন্য যে উদ্যম-উদ্দীপনা, সরকারি খাতে নিয়মানুবর্তিতা আর জবাবদিহি প্রয়োজন, তা প্রচলিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় সম্ভব নয় বলেই অধিকজনের বিশ্বাস। হয়তো প্রয়োজনও নেই। শক্তিশালী নীতি-পরিবেশে একটি দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধ ব্যক্তি খাতই যথেষ্ট।
অর্থনীতি বিশ্নেষক
মন্তব্য করুন