দুই সপ্তাহ ধরে মধ্যপ্রাচ্যে অধিকৃত জেরুজালেম এবং অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি সামারিক বাহিনী ও উগ্রপন্থি জনতা ফিলিস্তিনিদের ওপর যেভাবে হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তা নিকট ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিমান থেকে বোমা এবং স্থল থেকে গোলা হামলায় এরই মধ্যে দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত এবং কয়েকশ আহত হয়েছেন। অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক অবরোধে এরই মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও কর্মহীনতার শিকার গাজায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশিরভাগ ঘরবাড়ি। নিরস্ত্র একটি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে পরিচালিত এই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, রক্তপাত ও হামলা গণহত্যারই নামান্তর। বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের পাথর ও গুলতির বিপরীতে ইসরায়েলের 'অত্যাধুনিক' মারণাস্ত্র মানবের বিরুদ্ধে দানবের আগ্রাসন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। স্বীকার করতে হবে- গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসও বরাবরের মতো ইসরায়েলি এলাকা লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালিয়েছে; কিন্তু ইসরায়েল পরিচালিত হামলার সঙ্গে এর তুলনা বাতুলতা মাত্র।
আমরা এই হত্যাকাণ্ড ও রক্তপাতের তীব্র নিন্দা এবং অবিলম্বে হামলা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের সম্পাদকীয় অবস্থান সব সময়ই ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সংগত অধিকারের পক্ষে। বস্তুত সাম্প্রতিক এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে রোববার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে যে চিঠি দিয়েছেন, তা যথার্থ। ওই চিঠিতে ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে সংহতির বার্তার মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় অবস্থানই প্রতিফলিত। একই দিন ওআইসির কার্যনির্বাহী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য- ফিলিস্তিনে স্থায়ী ও টেকসই শান্তির বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, সে ক্ষেত্রে প্রথমেই চলমান হামলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অবিমৃষ্যকারিতা থেকে ইসরায়েলকে সরে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ও আন্তরিক ভূমিকা প্রত্যাশা করি আমরা। বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়, জাতিসংঘ এ ব্যাপারে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।
এমনকি চলমান অসম হামলায় এই বিশ্ব সংস্থা নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতেও ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব ঘটনাকে যেভাবে 'ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য' আখ্যা দিয়েছেন, তা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' ছাড়া আর কী হতে পারে! আন্তর্জাতিক মহলে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়াও তথৈবচ। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের 'লোক দেখানো' ফোনালাপ ইসরায়েলকে আরও উৎসাহিতই করেছে। অথচ ইসরায়েলের বর্তমান অবস্থান সুদৃঢ় করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কম নয়। আমাদের মনে আছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি- তিন ধর্মের কাছেই পবিত্র বিবেচিত এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রাচীন শহর জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হননি; সেখানে তাদের দূতাবাস স্থানান্তরও করেছিলেন।
লক্ষণীয়, এবারের হামলার সূত্রপাত হয়েছে জেরুজালেম থেকেই। আমরা জানি, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘ সাত দশকের বিরোধপূর্ণ ওই অঞ্চলে 'দুই রাষ্ট্র' সমাধানের যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে, তার মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ। যুক্তরাষ্ট্র চর্চিত পররাষ্ট্রনীতির বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমে ইসরায়েলের একক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে যে অবিমৃষ্যকারিতা প্রদর্শন করেছিলেন; জো বাইডেন তা শুধরে নেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করলেন না। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিরোধের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা আরও দুর্বল হয়ে গেল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার অগ্রাহ্য হতে পারে না।
মনে রাখতে হবে, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু এই ঘটনাপ্রবাহ এতদূর গড়িয়েছে ইসরায়েলের উস্কানিমূলক পদক্ষেপের কারণেই। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জিঘাংসামূলক বক্তব্য প্রমাণ করে- তারা রীতিমতো 'ছক কষে' এ হামলার পটভূমি তৈরি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই আগ্রাসী রাষ্ট্রটিকে থামাতে হবে। তাদের অন্তত ১৯৬৭-পূর্ববর্তী সীমারেখায় ফিরে যেতে হবে। আমরা দেখতে চাইব, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মুসলিমবিশ্বেরও ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আন্তরিকতার সঙ্গে পাশে থাকলে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র অবশ্যই সম্ভব।
বিষয় : গাজায় ইসরায়েলি হামলা
মন্তব্য করুন