- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ক্ষমাপ্রার্থী এক শিক্ষকের জবানবন্দি
ক্ষমাপ্রার্থী এক শিক্ষকের জবানবন্দি

করোনাভাইরাসে প্রভাব সব খাত কাটিয়ে উঠলেও শিক্ষা খাত বিশেষ করে পাবলিক শিক্ষার্থীদের পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় এখনও সেভাবে প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সমকালে ৭ মে প্রকাশিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে 'শিক্ষার্থীদের বারোটা বাজানোর কত দেরি' শীর্ষক লেখায় মাহফুজুর রহমান মানিক দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি বিবেচনায় একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের জবানবন্দিই পরবর্তী প্রয়াস।
আমি একজন শিক্ষক। জনগণের অর্থে পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং একটি বিভাগের চেয়ারম্যানও বটে! বৈশ্বিক করোনা মহামারি বিভিন্ন দেশ আক্রান্ত করে আমাদের দেশেও এলো। করোনাভাইরাস তার অদৃশ্য থাবা বিস্তার করতে লাগল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করল। অনেকেই নিজ বাড়িঘরে অভাবের সম্মুখীন হলো। আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের কিছুটা সহযোগিতা করলাম, তবে তা উল্লেখ করার মতো নয়। করোনার প্রকোপ থেমে যাওয়ার লক্ষণ না দেখে আমরা অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করি। শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা থাকলেও প্রথম দিকে অনলাইন ক্লাসে ভালোই সাড়া পাওয়া গেল। ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ হ্রাস পেতে লাগল এবং তাদের সীমাবদ্ধতা ও সমস্যাগুলো স্পষ্টতর হয়ে উঠল। আমরা শিক্ষার্থীদের নানা আশ্বাস দিয়ে অনলাইন ক্লাস চালিয়ে নিতে থাকলাম। আমরা বললাম, মোবাইল দেবো, ডাটা দেবো, সহজ শর্তে ঋণ দেবো ইত্যাদি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, যারা চূড়ান্ত বর্ষে আটকে আছে তাদের পরীক্ষা শেষ করব; চাকরির নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের তাগিদে তাদের ছেড়ে দেবো। সভা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, পরীক্ষার শিডিউল দিলাম; পরীক্ষা নিতে পারিনি! সংশ্নিষ্টদের জন্য সীমিত পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক আবাস খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলাম; খুলে দিতে পারিনি!
এ দীর্ঘ সময়ের দোলাচলে আমার অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে, পড়াশোনার গতি হারিয়েছে। মেয়েদের কারও কারও বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেদের অনেকেই এলাকায় নানা সমস্যায় জড়িয়েছে, বিবাদ-বিসম্বাদে নিপতিত হয়েছে। অর্থাভাব, ব্যক্তিগত হতাশা, পারিবারিক ঝামেলা ও সামাজিক অস্থিরতার প্রভাবে অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনের কক্ষচ্যুতি ঘটেছে। এদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ আর কখনও পড়াশোনার স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে পারবে বলে মনে হয় না। আমি তাদের শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবেছি, কিন্তু আমাদের চোখের সামনে একটা সম্ভাবনাময় প্রজন্ম মানসিকভাবে যে চরম ভঙ্গুর ও দুর্দশায় নিপতিত হয়ে গেছে, সেদিকে আমার ভ্রূক্ষেপ একবারেই অনুল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে আমার সামগ্রিক পরিকল্পনায় দ্বিধা, সময়োচিত পদক্ষেপ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা- সর্বোপরি আমার অনুভূতির জায়গাগুলো খুবই সংকীর্ণ। বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমি অপারগ, 'মানবিক' শব্দটি আমার কাছে অধরা, 'সাহস' কথাটি আমার কাছে অপরিচিত এবং দুর্ভাগ্যক্রমে আমার 'সততা' প্রশ্নবিদ্ধ। 'প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্য' আমার কাছে এক সুদূর অতীত এবং 'নগদ যা পাও হাত পেতে নাও' এটিই আমার বর্তমান জীবন-দর্শন! '৫২-এর উজ্জীবনী শক্তি, '৭১-এর মহান চেতনা, '৯০-এর দুর্বার গতি আর ২০০৭-এর ওয়ান-ইলেভেনের অসম সাহসিকতা ও দৃঢ়চেতা মনোভাব- এসবের কোনোটাই আর আমাকে প্রাণিত বা শানিত করে না। একইভাবে আমার মেধা-মনন, যোগ্যতা, নেতৃত্ব-গুণ ও ভাবাদর্শ- এগুলোও আর আমাকে পরিচালিত করতে পারছে না; ওহির দরজা বন্ধ হলেও সেই অদৃশ্য ওহির তালাশে অপরিণামদর্শী সব নির্দেশনা পালন করতে হয় আমাকে।
একেবারেই স্বল্প পরিসরে বলতে গেলে আমি এক অনুগত, অসহায় শিক্ষক। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রিয় শিক্ষার্থীদের জন্য আমার অবদান নেহাত কম! আমি মূলত আমার বিপদাপন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুই করতে পারিনি- এ বোধোদয়ই আমার একমাত্র সান্ত্বনা। তাই কথা না বাড়াই, আমি যেহেতু আমাকে বুঝতে পেরেছি, অতএব ইতোমধ্যে ঝরে পড়া ও জীবন-সংগ্রামে কোনো রকমে টিকে থাকা আমার সব শিক্ষার্থীর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী!
চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন