২০১৯ সালে পৃথিবীব্যাপী ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল পর্যটন শিল্প থেকে। অর্থাৎ জিডিপিতে অবদান ছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। পাশাপাশি একই বছর পর্যটন শিল্পে মোট ৩৩৪ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যা মোট কর্মসংস্থানের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। পৃথিবীর ৫১টি দেশের প্রধান শিল্প হচ্ছে পর্যটন শিল্প এবং পৃথিবীর সব উন্নত দেশের প্রধান পাঁচটি শিল্পের মধ্যে থাকে পর্যটন শিল্প। বিগত দুই দশক ধরে পর্যটন শিল্প পৃথিবীব্যাপী সব ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়। বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প এই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ৩ শতাংশ। তাছাড়া মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ২.৯ শতাংশ তৈরি হয় এই খাতে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে ধরা পড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এরপর থেকে সারা পৃথিবীতে এই ভাইরাসের প্রভাব পড়তে থাকে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন খাত, যার বিরূপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে ২০২০ সালে পর্যটনশিল্পে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার যা ২০১৯ সালের থেকে প্রায় ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ কম। এর ধাক্কা পড়েছে কর্মসংস্থানেও। ২০২০ সালে পর্যটনশিল্পে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে মাত্র ২৭২ মিলিয়ন যা ২০১৯ সালের থেকে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ কম। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে পর্যটনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে ২০০২ ও ২০০৪ সালে সার্স ভাইরাসের আক্রমণের সময় চীনে জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ২৫ শতাংশ কমে যায়। একই সময়ে হংকংয়ে জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ৪১ শতাংশ হ্রাস পায়। সিঙ্গাপুরের পর্যটন খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যায় প্রায় ২৫ শতাংশ। এবারের করোনাভাইরাসের প্রথম ধাক্কার প্রভাবে চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশে পর্যটনে ধস নেমেছে, যা আগের বারের চেয়ে আরও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ডের প্রায় ১০৯ বিলিয়ন থাই বাথ লোকসানের মুখে পড়েছে করোনার কারণে। এবার চীনের লুনার নববর্ষ উদযাপনের সময় থেকে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ পর্যটনে লোকসানের সম্মুখীন হয়। ইন্দোনেশিয়া জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেশটির চার বিলিয়ন বাণিজ্যিক ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া পৃথিবীর সব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশও এর বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্তি পায়নি। ২০২১ সালে এসে করোনার প্রকোপে প্রায় বিপর্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে। বর্তমানে ভারতে করোনার ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে যা চরম উদ্বেগের কারণ। এর ফলে পর্যটন শূন্য হয়ে পড়েছে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশ।
করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প-সংশ্নিষ্ট সব সেবা ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। তারপর কিছুদিন সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হলেও ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে তা আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প পড়ে সীমাহীন ক্ষতির মুখে। একদিকে পর্যটনশিল্প সম্পর্কিত সবাই যেমন হারিয়েছে তাদের মুনাফা, পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানহানি হয়েছে। পর্যটনশিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত সেক্টরের মধ্যে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্সি, এয়ারলাইন্স ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মতে, ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের পর্যটন খাতের সব ক্ষেত্রে প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। তবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। তাদের তথ্য মতে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং ঝুঁকির মুখে পড়েছে প্রায় ৪০ লাখ জনবল।

বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কমে আসায় গত বছরের শেষের দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যটকের ব্যাপক সমাগম হয়। বিশেষ করে সিলেট, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়িসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পর্যটকদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তাতে ওইসব অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা তাদের ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কাটিয়ে উঠেছেন। যদিও এই সময়ে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে অনেকে উদাসীন। এরপর ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে আবারও করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ফের বন্ধ হয়ে যায়। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দেশের হোটেল ব্যবসার বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যেখানে হোটেলগুলোতে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ অতিথি থাকার কথা, সেখানে দেশের হোটেলগুলোয় এখন মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ অতিথি রয়েছেন। কোনো কোনো স্থানে হোটেলগুলো একেবারেই বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারি সহায়তার পাশাপাশি পর্যটন স্থানগুলো খুলে দিতে হবে। তবে পর্যটনের সব স্থানে স্বাস্থ্যবিধি যাতে মানা হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি করতে হবে।
করোনার ধাক্কার কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। পর্যটন-সংশিষ্ট সবার কাছে দিন দিন টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে পর্যটন-সংশ্নিষ্ট ব্যবসাগুলো টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি তারা যাতে তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা দিতে পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ সহায়তা দিতে হবে।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে তিন হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ বাজেট বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। আর পর্যটন খাতের জন্য মাত্র ৭২৫ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এমনকি পর্যটন খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনাও দেওয়া হয়নি বিগত বাজেটে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে করোনা মোকাবিলায় পর্যটনশিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। পর্যটন খাতের জন্য নিতে হবে নানামুখী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। করোনা-পরবর্তী সময়ে যাতে এদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বেশি উৎসাহিত করা যায়, এজন্য করপোরেট করহার কমাতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের করপোরেট খাতের করহার বাংলাদেশের চেয়ে কম। ভারতে ২৫-৩০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ২২ শতাংশ, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে ২০ শতাংশ। পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ও সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। এ জন্য পর্যটনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব পক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশেষত অন্যান্য শিল্পের মতো পর্যটনকেও সহায়তা প্রদান করা এখন সময়ের দাবি।
পর্যটনশিল্প খাতে ব্যবসা মন্দার কারণে শ্রমিকদের একেবারে চাকরিচ্যুত না করে নূ্যনতম বেতন দিয়ে হলেও তাদের টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ শ্রমিকরা চাকরি হারিয়ে পেশা পরিবর্তন করলে পরবর্তী সময়ে আর অভিজ্ঞ শ্রমিক পাওয়া যাবে না এবং এটি সারাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া সার্বিক করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে ধাপে ধাপে পর্যটনস্থানগুলো খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে পর্যটনের সঙ্গে সম্পর্কিত সবাইকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া যেসব পর্যটক করোনার টিকা নিয়েছেন, তাদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিদেশি পর্যটকের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে করোনার টিকা গ্রহণ করেছেন, তাদের আকর্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাবনাময় অধ্যায়ের নাম। এ শিল্প টিকিয়ে রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সরকার ও আমাদের দায়িত্ব। এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে এসে করোনাভাইরাসকেও মানুষ জয় করে টিকে থাকবে। পৃথিবীব্যাপী পর্যটনক্ষেত্র চালু করার জন্য বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যা আমাদের জন্য অনুকরণীয়। পাশাপাশি শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা যথাসম্ভব মেনে চললে করোনাভাইরাস আমরা জয় করতে পারব। এমতাবস্থায় আমরা আমাদের পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসা পুনরায় চালু করতে পারি।

অধ্যাপক, চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়