বঙ্গোপসাগরে দেখা দেওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস' শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এড়িয়ে ভারতের ওডিশায় আঘাত হেনেছে- এটা শঙ্কার মধ্যেও স্বস্তির খবর হতে পারত; কিন্তু আমরা দেখছি, ঘূর্ণিঝড় অন্যদিকে চলে গেলেও এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট দুর্যোগ ও দুর্ভোগের হাত থেকে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল রেহাই পায়নি। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যে উপকূলীয় ৯ জেলায় ২৭টি উপজেলা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বুধবার জানানো হয়েছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে শিশুসহ অন্তত আটজনের প্রাণহানিও ঘটেছে। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, মাঠ পর্যায়ে চূড়ান্ত চিত্র পাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়বে। বস্তুত 'ইয়াস' ভরা কটাল বা পূর্ণিমার সময়ে বঙ্গোপসাগর অঞ্চল অতিক্রম করায় জোয়ারের উচ্চতা এলাকাভেদে স্বাভাবিকের তুলনায় ছয় থেকে আট ফুট বেশি নিয়ে এসেছিল। এতে করে উপকূলীয় অনেক এলাকায় সুরক্ষা বাঁধের অন্তত ৪৫টি স্থানে মোট ২৭ কিলোমিটার ভেঙে গেছে বলে সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আরও অর্ধশতাধিক স্থানে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানে কীভাবে বাঁধ উপচে জোয়ারের পানি লোকালয় ও ফসলের ক্ষেতে প্রবেশ করেছে, সেই চিত্র সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে।

অতীতে কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় ভরা কটালের সময় আঘাত হেনে বাংলাদেশে ধ্বংসের পথরেখা রেখে গিয়েছিল। এবার ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও বাঁধ ভেঙে ও উপচে নোনাপানি প্রবেশের এই ক্ষতি নেহাত কম নয়। আমরা জানি, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা এখন বৈশ্বিক উদাহরণ। আমাদের দেশে নব্বই দশকে প্রণীত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে এরই মধ্যে প্রমাণিত। যে কারণে নব্বইয়ের দশকের পর ক্রমেই কমতে থাকে প্রাণহানি। ঘূর্ণিঝড় থেকে সুরক্ষায় স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নকশা করার উদ্যোগও যথেষ্ট উদ্ভাবনীমূলক। এমনকি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন মোকাবিলায় যে মাটির ঢিবি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই 'মুজিব কেল্লা' এখনও দুর্যোগ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে। এই ব্যবস্থা বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় থেকে গবাদি পশু রক্ষায় হয়ে উঠছে অন্যতম প্রধান ভরসা। আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা যেভাবে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যায়, তার উদাহরণও বিশ্বে কম রয়েছে। এও স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ব্যবস্থাও এখন আন্তর্জাতিক মানের। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও পক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে আমরা এখন তিন-চার দিন আগেই ঘূর্ণিঝড়ের ধরন ও সম্ভাব্য গতিপথ বলে দিতে পারি।

সর্বশেষ 'ইয়াস' যখন নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হচ্ছিল, তখনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখন নজর দিতে হবে বাঁধ ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী ও সংহত করার দিকে। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মিত উপকূলীয় বাঁধ ব্যবস্থা এখন বহুলাংশে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সিডর, আইলা, মহাসেন কিংবা আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়গুলোর সময় দেখা গেছে, ঝোড়ো বাতাসের তাৎক্ষণিক ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে বাঁধ ভেঙে প্রবেশ করা জলোচ্ছ্বাস। এবারের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় উপকূলীয় বাঁধগুলোর উচ্চতা আরও অন্তত ১০ ফুট বাড়ানো উচিত বলে আমরা মনে করি। তাহলে ফসল ও বসতবাড়ির ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি যখন দৃশ্যমান, লবণাক্ততার আওতা যখন ক্রমে বাড়ছে; তখন এর বিকল্পও নেই। আইলার সময়ই আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে বলেছিলাম যে, বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে না পারলে ঘূর্ণিঝড়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বাড়তেই থাকবে। আমরা বলেছিলাম, উপকূলীয় বাঁধ যদি মজবুত না হয়, তাহলে জলোচ্ছ্বাসে নোনাপানি ফসলের ক্ষেতে প্রবেশ করে খাদ্য উৎপাদন ও জীবিকা বিপন্ন করে তোলে। গত বছর আম্পান এবং সদ্য চলে যাওয়া ইয়াসের সময় আমাদের আশঙ্কাই সত্য হলো। আরও হতাশার বিষয়, আইলার সময় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলোর মেরামত ও সংস্কার কাজও গত এক যুগে সম্পন্ন করা যায়নি। বিলম্বে হলেও বিষয়টিতে নজর দেওয়া হবে বলে প্রত্যাশা।

বিষয় : ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস'

মন্তব্য করুন