শিরোনামে ব্যবহূত দুটি শব্দই অধিকাংশ মানুষের কাছে অপরিচিত। কিন্তু এই শব্দদ্বয় যা বোঝায়, তা সবার কাছে অতিপরিচিত বিষয়। 'আরবোরেটাম' হলো এক ধরনের বিশেষ উদ্ভিদ উদ্যান এবং মান্দি বা গারো ভাষায় 'মাংরুদাম' মানে শ্মশান। অপরিচিত শব্দের মোড়কে এই অতিপরিচিত বিষয় নিয়ে সম্প্রতি আবারও তর্ক উঠেছে মধুপুর শালবনে। ক্ষয়িষুষ্ণ এই বনের তিন হেক্টর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে আরবোরেটাম। এই কাজে বন বিভাগ প্রায় চার হাজার ৮০০ গাছের চারা রোপণ করেছে। এর ভেতর আছে গামারি, গর্জন, গজারি, চাপালিশ, কানাইডিঙ্গা, বহেড়া, ডুমুর, সিধা, ওজা, হরীতকী, আমলকী, গাদিলা, পিত্তরাজ, কাঞ্চন, বনআমড়া। কিন্তু আরবোরেটাম গড়ে তুলতে প্রাকৃতিক বনের ভেতর বন বিভাগ আবারও চারদিকে ইটের দেয়াল ও ব্যারাক নির্মাণ করছে। আর তাতেই শঙ্কা ও সন্দেহ জেগেছে আদিবাসীদের মনে। এর আগেও বন বিভাগ ইকোপার্কের নামে ২০০৪ সালে প্রাকৃতিক বনের তিন হাজার একর কোর এলাকাকে ৬১ হাজার ইটের দেয়াল দিয়ে বন্দি করেছিল। বনমুক্তির আন্দোলনে জীবন দিয়েছিলেন পীরেন স্নাল। কেন তর্ক উঠেছে আরবোরেটাম নিয়ে? কারণ, অরণখোলা ইউনিয়নের টেলকি গ্রামের এই অংশে আছে প্রাচীন এক মাংরুদাম। এই লেখা আরবোরেটাম ও মাংরুদামের পক্ষে। কারণ, প্রাণ-প্রকৃতি ও বাস্তুসংস্থান সুরক্ষায় এদের উভয়ের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভিদ উদ্যান অবশ্যই মাংরুদামের মতো স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়েই তৈরি হওয়ার কথা। দুনিয়াজুড়ে প্রতিষ্ঠিত সব উদ্ভিদ উদ্যান তা-ই করেছে।

আরবোরেটাম ও আদিবাসী

আরবোরেটাম এক ধরনের এক্স-সিট্যু পদ্ধতির সংরক্ষণ প্রক্রিয়া। বাগান বা উদ্যানের মতো নানা জায়গা থেকে বৃক্ষপ্রজাতি একটি জায়গায় এনে অনুশীলন ও বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আরবোরেটাম গড়ে তোলা হয়। এ ছাড়া এই বিশেষ উদ্ভিদ উদ্যান প্রকৃতিপাঠ ও শিখনভিত্তিক পর্যটনেও ভূমিকা রাখে। ১৮৩৩ সালে জন ক্লদিয়াস ল্যুডন 'দ গার্ডেনার্স ম্যাগাজিনে' এই প্রত্যয় ব্যবহার করেন। ফ্রান্সের আরবোরেটাম ডি পিজারিন, সুইডেনের নর, তুরস্কের আতাতুর্ক, নিউজিল্যান্ডের ইস্টউড হিল, ওয়াশিংটন ডিসি জাতীয় আরবোরেটাম, ভারতের উটি, ক্যানবেরা আরবোরেটাম দুনিয়ার গুরুত্ববহ সব উদ্ভিদ উদ্যান। পৃথিবীর সব বিখ্যাত আরবোরেটাম ও উদ্ভিদ উদ্যান আদিবাসীসহ স্থানীয় জনগণের উদ্ভিদজ্ঞান ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করছে। জনউদ্ভিদবিদ্যা এসব অনেক উদ্যানের অন্যতম শক্তি।

বিস্মৃত মাংরুদাম

মান্দিদের আদি সাংসারেক ধর্মরীতি অনুযায়ী মৃতের সৎকার ও দাহ হয় মাংরুদামে। মধুপুর শালবনের ভূপ্রকৃতি অনুযায়ী চালা ও বাইদ দুই ধরনের ভূমি দেখা যায়। প্রাচীন মাংরুদামগুলো গড়ে উঠেছিল বনের ভেতর চালা জমিনে। 'মিদ্দি আসং' বা পবিত্র পূজাস্থলের মতোই মাংরুদামগুলোও সামাজিকভাবে পবিত্র এলাকা হিসেবে সংরক্ষিত হতো। এমন এলাকায় শজারু, অজগর, গুইসাপ, উইঢিবি, মৌমাছির চাক, চামড়াঝোলা ব্যাঙ, ময়ূর, হরিণ, চিতা, সর্পগন্ধা, শতমূলী, হস্তীকর্ণপলাশ, অশ্বগন্ধা, কুচ, বচ, তুরুকচণ্ডাল, দামবং নামে মাশরুম ও ফার্নের মতো বিরল বন্যপ্রাণের আধিক্য ছিল বেশি। এসব অঞ্চল থেকে কোনো কিছু সংগ্রহ বা উত্তোলন করা যেত না। প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে ১৯৫০ সালের পর থেকে মধুপুরে নিষিদ্ধ হয় জুম চাষ। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয় গরিষ্ঠ মান্দি সমাজ। নতুন ধর্মকৃত্যের কারণে আদি মিদ্দিআসং ও মাংরুদামগুলো বিস্মৃত হতে থাকে। মধুপুর আরবোরেটাম গড়ে তোলা হচ্ছে এমনই এক শতাব্দীপ্রাচীন মাংরুদামের ওপর। ক্যাজাই গ্রামের কানচ নকরেকের বাবা রামমোহন চিরান, জলইয়ের রজনী হাগিদকের মা রেংজি হাগিদক, রাজাবাগির নিরলা চিরানের দাদু মংলা চিচাম ও দাদি জিজি চিরান, গায়রার অনতি নকরেকের বাবা থিনেন্দ্র সিমসাং এমন সহস্রপূর্বজন ঘুমিয়ে আছেন এই মাংরুদামের তলায়। মাংরুদাম থেকে ফেরার পর বাড়িতে নারীরা রাও (এক ধরনের লাউপাত্র) থেকে চু (ঐতিহ্যগত পানীয়) ঢেলে 'সামরাংগালা' কৃত্য করতেন। সুর টেনে টেনে আত্মাকে বলতেন, '...কোনো সকশ শয়তান যেন বাড়িতে না আসে, আমরা সবকিছু যমকে মাংরুদামে দিয়ে এসেছি।' মৃতের স্মরণে মাংরুদামে স্থাপিত হতো নানা মাপের ও নকশার স্মৃতিস্মারক 'খিমা'। প্রতিটি মাংরুদাম ঘিরে এমন শতসহস্র গল্প মিশে আছে মধুপুর শালবনে।

পবিত্র অঞ্চল সুরক্ষা কেন জরুরি

জাতিসংঘ, বিদ্যায়তন কি পাবলিক পরিসরে আদিবাসীসহ স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস ও ধর্মীয় কৃত্যের মাধ্যমে প্রাণপ্রকৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি আজ গবেষিত ও স্বীকৃত? দেখা গেছে, এমন পবিত্র অঞ্চলগুলোই পাখিসহ দুর্লভ বন্যপ্রাণের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং এখানেই দেখা মেলে হারিয়ে যাওয়া বিরল উদ্ভিদ ও প্রাণীর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০০২ সালে দেশের পবিত্র উদ্ভিদ ও পবিত্র বনপ্রতিবেশ অঞ্চলের এলাকাভিত্তিক সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করি। ১০ জুলাই ২০০৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে ঔষধি উদ্ভিদ-সংক্রান্ত অ্যাডভাইজরি কমিটির সভায় ২৯ নম্বর সিদ্ধান্ত হিসেবে 'দেশের ঐতিহ্যবাহী পবিত্রবৃক্ষ ও বনাঞ্চলসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য' কার্যকর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০০৩ সালে প্রকাশিত 'মধুপুরের প্রাণবৈচিত্র্য' বইতেও মধুপুরের জনউদ্ভিদতাত্ত্বিক বিবরণ আছে। মধুপুরে জনউদ্ভিদ গবেষণায় ৫৯ উদ্ভিদ পরিবারের ১০৯ প্রজাতির উদ্ভিদের নানাবিধ মান্দি ব্যবহার জানতে পেরেছি, যেসব উদ্ভিদের গরিষ্ঠভাগই একসময় মাংরুদাম বা মিদ্দিআসংয়ের মতো পবিত্র সংরক্ষিত অঞ্চলে পাওয়া যেত। আদিবাসী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে ১৪ আগস্ট ২০০৪ তারিখে আদিবাসী এলাকার পবিত্র বৃক্ষ ও পবিত্র এলাকা সংরক্ষণবিষয়ক একটি খসড়া রূপরেখা ও প্রস্তাব সরকারের কাছে প্রেরণ করি। পরে 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২' পবিত্র উদ্ভিদ, স্মারক বৃক্ষ, পবিত্র বন, কুঞ্জবন সংরক্ষণের নির্দেশনা দেয়। টাঙ্গাইল বন বিভাগ এখন কী করবে? জনগণের খাজনার টাকায় গায়ের জোরে এক বিস্মৃত মাংরুদামের ওপর আরবোরেটাম বানাবে নাকি স্থানীয়দের ঐতিহ্য, ইতিহাস, উদ্ভিদজ্ঞান এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জেনে বিজ্ঞানভিত্তিক সৃজনশীল পদক্ষেপ নেবে?

একটি জনউদ্ভিদ আরবোরেটাম

মধুপুর বনের আরবোরেটামটি একটি জনউদ্ভিদ আরবোরেটাম হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এখানে মধুপুর শালবনের উদ্ভিদবৈচিত্র্য সংরক্ষিত হবে। এসব উদ্ভিদের পাশে মান্দি-কোচসহ স্থানীয় মানুষের উদ্ভিদজ্ঞানের বিবরণ থাকবে। লোকায়ত ভূমিবিন্যাস অনুযায়ী কোন ধরনের উদ্ভিদ কেমন স্থানে জন্মে এবং বন্যপ্রাণের সঙ্গে মানুষের সমাজের কী সম্পর্ক, তার নমুনা থাকবে। লোকায়ত পরিবেশ ও প্রকৃতি ব্যবস্থাপনার অডিও, ভিডিও, পোস্টার ও নমুনা প্রদর্শিত হতে পারে। প্রবীণ কবিরাজ এবং খামালদের নিয়ে বিশেষ শিখন কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। স্থানীয় আদিবাসী যুবদের প্রশিক্ষিত করে আরবোরেটাম ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করতে হবে। যুক্ত হতে পারে লোকায়ত চিকিৎসাসেবা, মান্দিরীতির খাদ্য আয়োজন কিংবা প্রকৃতিবান্ধব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রাকৃতিক বনের ভেতর ইটের দেয়ালে কিছু গাছের চারা লাগিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ পূর্ণ করা নয়, সত্যিকারভাবেই মধুপুর বনে একটি জনউদ্ভিদ আরবোরেটাম গড়ে তোলা সম্ভব।

গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ

animistbangla@gmail.com