করোনা অতিমারির মধ্যে আমরা আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করছি। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে 'বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা'। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা বুঝতে পেরেছি, ইকোসিস্টেমগুলোকে ধ্বংস করে মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ আনা যায়নি। ইকোসিস্টেমগুলো ধ্বংস করা হয়েছে নানা কাজে, নানা সময়ে। বিশেষ করে ধ্বংস করা হয়েছে নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রয়োজনে। প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা কি নগরায়ণ ও শিল্পায়ন করব না? আমরা নগরায়ণ ও শিল্পায়ন অবশ্যই করব। কিন্তু এতদিন ধরে আমরা 'আগে উন্নয়ন, পরে পরিবেশ' মডেলকে অনুসরণ করে এসেছি। এর বৈশ্বিক বিপর্যয় আমরা দেখছি। নানা বিপর্যয়ের মুখে মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে, এ মডেল সঠিক নয়। আমাদের উন্নয়ন করতে হবে পরিবেশকে রক্ষা করে। অর্থাৎ উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশকেন্দ্রিক, পরিবেশ কখনও উন্নয়নকেন্দ্রিক হবে না।

গোটা পৃথিবীর মোট ভূমির ২৫ ভাগ মারাত্মক ভূমিক্ষয়ের মুখোমুখি। ইতোমধ্যে ৩.২ বিলিয়ন মানুষ ভূমিক্ষয়ের শিকার হয়েছে। এখন গোটা বিশ্বের ৪৬ ভাগ কৃষিজমি ভয়াবহ ভূমিক্ষয়ের সম্মুখীন। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশে দশ দশমিক সাত মিলিয়ন হেক্টরের বেশি ভূমি ক্ষয় হয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই, যেখানে ভূমিক্ষয় হয়নি। বাংলাদেশের ৭২ মিলিয়ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ভূমিক্ষয়ের নেতিবাচক প্রভাবের মুখোমুখি পড়েছে। এটা হয়েছে অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করার কারণে। আমাদের ভূমির উর্বরতা অনেক কমে এসেছে। বাংলাদেশের বনভূমির পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মতে, বনভূমির পরিমাণ ছয় থেকে সাত ভাগ। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে বনভূমি আছে তিন লাখ ৩৮ হাজার একর। এর মধ্যে এক লাখ ৩৮ হাজার একর বনভূমি দখল হয়ে যাওয়ার কথা বলছে বন বিভাগ। সারাবিশ্বে বন উজাড়ের বার্ষিক হার এক দশমিক চার ভাগ। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে এ হার দুই দশমিক আট ভাগ। আমাদের মোট বনভূমির প্রায় অর্ধেক বেদখল হয়েছে, এর সঙ্গে যদি এত অধিক হারে বন উজাড় হতে থাকে, তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে বনশূন্য হয়ে পড়বে। বন উজাড়ের ফলে বন্যপ্রাণীরাও হুমকির মুখে পড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাশারের (আইইউসিএন) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের প্রায় ৯ ভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

জলাশয় হারিয়ে যাওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে হুমকিগ্রস্ত এশিয়া মহাদেশ। আর এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা বাংলাদেশের। আমাদের নগর এলাকার ৮২ ভাগ জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দখলে-দূষণে আমাদের নদনদীগুলোর বেহাল অবস্থার কথা কারও অজানা নয়। বঙ্গোপসাগরে প্লাস্টিক দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ফলে অনেক প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। মৎস্য উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। কিন্তু আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য অনেকটাই হারিয়ে গেছে। আমরা চাষ করা মাছে বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদ উৎপাদনে আর আগের মতো উদ্যোগী হচ্ছি না। নদনদীর দূষণ রোধ করা না গেলে কোনোভাবেই প্রাকৃতিক প্রজাতির মৎস্য সম্পদকে রক্ষা করা যাবে না। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিপদাপন্ন ১০ প্রজাতির মাছের মধ্যে সাত প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে।

আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশের এ হাল হওয়ার কারণ, আমরা উন্নয়নের যে মডেল বেছে নিয়েছি, তা অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। আমরা প্রকৃতিকে সম্মান না করে বরং কীভাবে প্রকৃতির ওপর জয়ী হওয়া যায়, সেটা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের ধারণা, বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশ উন্নত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর জিডিপি হারায় তিন থেকে পাঁচ ভাগ, পরিবেশ দূষণের কারণে হারায় এক থেকে তিন ভাগ, আর এক ভাগ জিডিপি হারায় বায়ুদূষণের কারণে। আমরা উন্নত বিশ্বের সেই উন্নয়ন মডেলকেই বেছে নিয়েছি, যার কারণে পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়েছে, অধিক হারে উজাড় হচ্ছে বন। বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর ভাবনায় আধুনিক কৃষির প্রবর্তন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু ভূমিক্ষয়ের যে পরিসংখ্যান আমরা দেখছি, সেই বাস্তবতায় কি আধুনিক কৃষি এই বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারবে? আমরা খাদ্য চাহিদার মূল জোগানদাতা তথা প্রাকৃতিক কৃষিকে ধ্বংস করছি। বাংলাদেশ সরকারের জৈব কৃষিনীতি রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নিরাপদ খাদ্যের জন্য জৈব কৃষিই হচ্ছে আগামীর একমাত্র সমাধান। কিন্তু সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না।

হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো বুড়িগঙ্গা দূষণ করল। বুড়িগঙ্গার পানি পরিশোধন করার পর্যায়ে থাকলে আমরা এখান থেকে পানি নিয়ে ঢাকা শহরের পানির অভাব পূরণ করতে পারতাম। সরকার মাত্র কয়েকজন ট্যানারি মালিককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। পরে এই ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া হলো সাভারে। এখন ধলেশ্বরী নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ধলেশ্বরীর পানিতে কৃষক আর চাষাবাদ করতে পারে না, মৎস্যজীবীরা নদী থেকে মাছ সংগ্রহ করতে পারে না। ট্যানারির দুর্গন্ধে নানাবিধ বিষাদে ভুগছে সাভারের মানুষ। ট্যানারিগুলোতে চরম অনিরাপত্তা আর দূষিত পরিবেশ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে শ্রমিকরা। কখনও এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ট্যানারি মালিকরা শ্রমিকদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে এবং সরকারও তাদের দাবি মেনে নেয়। এমতাবস্থায় ঢাকা শহরের কোটি কোটি মানুষের স্বার্থ এবং দুটি ইকোসিস্টেমকে রক্ষা করা হবে, নাকি কতিপয় ট্যানারি মালিকের খবরদারি চলবে- এ ব্যাপারে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার যদি পরিবেশ রক্ষায় মনোযোগী হতো তাহলে ট্যানারি মালিকরা আরও বেশি লাভবান হতো। কারণ পরিবেশদূষণের কারণে তাদের বিদেশি ক্রয়াদেশ কমে এসেছে। সরকার পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্ব দিলে তাদের ব্যবসাও ভালো চলত, আবার শ্রমিকরাও ভালো মজুরি পেত। মনে রাখতে হবে, ইকোসিস্টেম ধ্বংস করা যায়, কিন্তু সৃষ্টি করা যায় না। যে জিনিস আমরা সৃষ্টি করতে পারব না, তা আমরা ধ্বংস করতে পারি না। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি ট্যানারি শিল্পের ব্যাপক চাহিদা আছে। এর কাঁচামালও আমাদের নিজস্ব।

ইকোসিস্টেম আমাদের বহুমাত্রিক সেবা দেয়। সুন্দরবনের কথা ধরা যাক। সুন্দরবনে বাঘ থাকে, হরিণ থাকে কিংবা সেখানে বহু প্রজাতির বৃক্ষ ও পশুপাখি থাকে- বিষয় কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়; সুন্দরবন আমাদের নানাবিধ দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছে। আগামী দিনে এই দুর্যোগের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি। সেই সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, পায়রায় যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, আমরা সেই বিদ্যুৎই নিতে পারব না, কারণ আমাদের আর চাহিদা নেই। অর্থাৎ রামপাল চালু হওয়ার আগেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে কেন সেখানে এই প্রকল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন? আমরা দেখি একনেকে সিদ্ধান্ত হয় যে, পরিবেশ অধিদপ্তর সময়মতো ছাড়পত্র না দিলে প্রকল্পের কাজ আপনা-আপনি শুরু হয়ে যাবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ প্রতিবেদন দিয়েই ছাড়পত্র নিতে হবে। পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ প্রতিবেদনের কাজ শুরু করতে হয় প্রকল্প শুরুর আগেই। রামপালে বিপুল অর্থ ব্যয় করে জমি অধিগ্রহণের পর পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করা হয়, যার অর্থ পরিবেশ এবং বন অধিদপ্তরকে প্রকল্পের ব্যাপারে সবুজ সংকেত দিতেই হবে। আন্তর্জাতিক আইন না মেনে এভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেওয়া অবিবেচনাপ্রসূত। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে, যথাযথভাবে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ না করে, জনমতকে উপেক্ষা করে যদি কোনো উন্নয়ন করা হয়, তাহলে তা কখনই টেকসই হবে না। এখনও সময় আছে, আমাদের নদ-নদী, জলাশয় এবং বনভূমিগুলো রক্ষা করতে হবে। আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকাকে রক্ষা করতে হবে। ঢাকার জলাশয়গুলো ভরাট করা যাবে না। বনভূমির পরিমাণ অবশ্যই ২৫ ভাগে উন্নীত করতে হবে। এসব বাস্তবায়নে আমাদের যথেষ্ট আইন আছে। পরিবেশ আইনের উদ্দেশ্য হারানোর অর্থ হলো সংবিধানে পরিবেশ রক্ষার রাষ্ট্রীয় যে অঙ্গীকার আছে তা ক্ষতিগ্রস্ত করা। আমাদের সবক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সেখানে বিশেষজ্ঞদের স্থান দিতে হবে।

আমাদের কৃষিব্যবস্থাকে রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল করে রাখলে তা মোটেও সুফল বয়ে আনবে না। কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষককে সঙ্গে নিয়ে আদি প্রজাতিগুলোর সম্প্রসারণে গবেষণা করতে হবে। ঢাকা যেমন আমাদের প্রিয় শহর, তেমনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছে পাহাড়, বন তাদের মায়ের সমান। প্রকৃতিকে রক্ষা করে তারা যে উপায়ে পরিবেশসম্মতভাবে বসবাস করছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে কাজে লাগাতে হবে। একতরফাভাবে উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে বন, পাহাড়, সমুদ্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি, বেলা