- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বড় আত্মবিশ্বাস, বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ
বাজেট ২০২১-২২
বড় আত্মবিশ্বাস, বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ
জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার যে বাজেট পেশ করা হয়েছে, তাতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছেন স্বীকার করতে হবে। আমরা দেখছি, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গত এক যুগ ধরে বাজেটের আকার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি হয়ে আসছিল। কিন্তু একটি সম্পূর্ণ অর্থবছর করোনা পরিস্থিতিতে কাটানোর পরও সেই প্রবণতা অব্যাহত রাখতে পারা কম আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক নয়। বিশেষত করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিকভাবেই প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করছে, সেখানে এই বাজেটে প্রক্ষেপিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ ধরে রাখা সহজ বিষয় নয়। এই আত্মবিশ্বাস স্বাগত জানিয়েও আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, গত বছর বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রক্ষেপণ হলেও প্রাথমিক হিসাবে তা ৬ দশমিক ১ শতাংশ সম্ভব হয়েছে। বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে প্রবৃদ্ধির উচ্চহার দেখিয়ে লাভ কী? আমরা বরং দেখতে চাই, জাতীয় বাজেটে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ও হার নির্ধারণ করা হবে এবং তা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পথরেখা থাকবে। দুর্ভাগ্যবশত, ঘোষিত বাজেটে সেই প্রবণতা কম। শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রধান প্রতিবেদনে যথার্থ বলা হয়েছে যে, বাজেটে করোনা মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুজ্জীবেেনর অনেক প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবায়নের পথনকশা অস্পষ্ট।
বিশেষভাবে যে দিকটি বলতে হবে, নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত বরাদ্দ বাড়েনি। মোট বাজেট ও জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ আগের বছরের মতোই। কেবল স্বাস্থ্য নয়, শিক্ষা, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতেও চিত্র তথৈবচ। অর্থাৎ বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও মোট বাজেটের অনুপাতে আগের মতোই। তাহলে কীসের ভিত্তিতে আমরা বাজেটটিকে 'জনমুখী' বলতে পারি? আরও যে বিষয়টি আমাদের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করেছে, তা হচ্ছে, গত এক-দেড় বছরে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। অথচ চলমান করোনা পরিস্থিতিতে ঘোষিত বাজেটে এই বিষয়টিতে জোর দেওয়া উচিত ছিল। কারণ এটাই সময়ের দাবি বলে আমরা মনে করি। বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা সংস্থা সিপিডিও একই পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে, ঘোষিত বাজেটে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়লেও সামনে অপেক্ষা করছে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনগুলোতে সরকারকে মনে রাখতে হবে, আসন্ন অর্থবছর শুরু হচ্ছে 'বৃহত্তম ঘাটতি বাজেট' নিয়ে। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে দুই লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার ব্যবধান ঘোচানো সহজ নয়।
এটাও মনে রাখা জরুরি, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে অনুদান প্রবাহেও টান পড়ার শঙ্কা জোরালো। আবার আপৎকালীন পরিস্থিতিতে ব্যয়ের অঙ্কও প্রাক্কলনের তুলনায় বেড়ে যেতে পারে। তাহলে এই ফাঁক আমরা কী দিয়ে মেটাব? রাজস্ব আদায় ও তার সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তরণ সম্ভব, সন্দেহ নেই। কিন্তু সে জন্য যে সংস্কার ও সুশাসন প্রয়োজন, তার প্রতিশ্রুতি বাজেটে স্পষ্ট নয়। বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলেেন শুক্রবার অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন যে, 'আমরা ঋণ নেব না, ঋণ দেব'। এই আত্মবিশ্বাস দেখা ও দেখানো নিশ্চয়ই সাধুবাদযোগ্য। বস্তুত বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে 'উচ্চাভিলাষী' বাজেটই উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বুঝতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো একটি দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলেও বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব তারা এড়াতে পারে না। করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে তাই গোটা বিশ্বই এক অনিশ্চিত সময়ের মুখোমুখি।
ঘোষিত বাজেটে সেই সময়ের সতর্কতা ও দূরদর্শিতা কতখানি প্রতিফলিত হয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের সন্দেহ রয়ে গেল। আমরা দেখতে চাই- আগামী কয়েক দিনের বাজেট অধিবেশনে বিদ্যমান অস্পষ্টতা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং প্রয়োজনে সংশোধন হবে। এখন আমরা প্রত্যাশা করব- বাজেট, বরাদ্দ, লক্ষ্যমাত্রা যেমনই হোক- সুশাসনে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সূচক সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। করোনা পরিস্থিতিতেও সেসব প্রশ্নের আন্তরিক জবাব দিতে না পারা হবে আত্মঘাতী।
মন্তব্য করুন