সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, বাইডেন প্রশাসন দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতের নেতৃত্বে কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের পেটেন্ট মুক্ত করার জন্য ১০০টিরও বেশি দেশের আন্তর্জাতিক দাবিকে সমর্থন করছে, যাতে দরিদ্র দেশগুলো এই ভ্যাকসিনটি তাদের জনগণের কাছে সহজলভ্য করতে পারে। জার্মানি ও সুইডেনের এই পরিকল্পনায় বিরোধিতা সত্ত্বেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ মহৎ উদ্দেশ্যে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবছে। এখন আমরা আলোচনা করে দেখব, কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের পেটেন্ট ছাড় দরিদ্র নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য সহজেই ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট কিনা।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১ আগস্টের মধ্যে ডেভেক্স ফান্ডিং তথ্য অনুসারে, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং নোভাভ্যাক্স ভ্যাকসিনগুলোর গবেষণা ও বিকাশ এবং সেগুলোর উৎপাদন ও বিতরণের জন্য ৩৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই তহবিল উন্নত দেশের সরকার, দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় সংস্থা, এনজিও এবং বেসরকারি খাত থেকে এসেছে। বাস্তবায়িত প্রোগ্রামগুলোতে ৬৪৪ মিলিয়ন ডলার, বিতরণের চুক্তির মাধ্যমে ১০০ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার এবং অনুদানের মাধ্যমে ৯২ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তায় এ জাতীয় তহবিল পরিচালিত হয়েছিল।
বিপুল বিনিয়োগকে সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে উন্নত দেশগুলো এবং তাদের অংশীদাররা পেটেন্ট অফিসে ভ্যাকসিন সম্পর্কিত সব তথ্যের একটি তালিকা যেমন ভ্যাকসিনের উদ্ভাবক এবং পেটেন্ট আবেদনকারী বা পেটেন্ট ধারক সম্পর্কে তথ্য, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও তদসম্পর্কিত উন্নয়নের বিশদ বিবরণ এবং পেটেন্ট সুরক্ষার পরিব্যাপ্তি ইত্যাদি জমা দেয়। শুধু তাই নয়, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ নীতি প্রয়োগ করে তারা বিদেশে রপ্তানি করার আগে তাদের জনগণের জন্য ভ্যাকসিন ডোজগুলো সুরক্ষা এবং তাদের স্থানীয় বাজারকে অগ্রাধিকার দেয়। তথ্যমতে, ১০টি দেশ এখন পর্যন্ত সমস্ত কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ৭৫ শতাংশ মজুদ করেছে এবং ১৩০টি দরিদ্র দেশ এখনও একটি ডোজ পায়নি। আরও জানা গেছে, ২৭টি ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে অনুমোদিত চারটি ভ্যাকসিনের মোট ৪২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডোজ গ্রহণ করেছে, কার্যত তাদের পুরো জনসংখ্যা যা বিশ্বের জনসংখ্যার মাত্র ১৪% টিকা দেওয়ার প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন ডোজ বেশি। অন্যদিকে, বাকি ৮৬% জনসংখ্যার দরিদ্র দেশগুলোতে মাত্র ৬৭০ মিলিয়ন ডোজ রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স, কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রেপারেডনেস ইনোভেশনস (সিপিইআই) এবং জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কোভাক্স প্রোগ্রামটি বাস্তবায়ন করে। কোভাক্সের প্রাথমিক লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে ২ বিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করা। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য এই উদ্যোগটি আক্ষরিক অর্থেই একটি লাইফলাইন এবং একমাত্র কার্যকর উপায় যার মাধ্যমে তাদের নাগরিকরা কভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলো পাবে। এটি উন্নয়নশীল দেশ এবং উদীয়মান অর্থনীতির কমপক্ষে ২০ শতাংশ লোককে ভ্যাকসিন পেতে সহায়তা করবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীন ট্রিপস কাউন্সিলের মাধ্যমে ট্রিপস চুক্তি ১৯৯৪ সালের পেটেন্ট বিধানকে সাময়িক স্থগিতকরণ, বাধ্যতামূলক লাইসেন্সিং এবং সমান্তরাল আমদানিসহ অন্যান্য বিকল্প পথ অবলম্বন করে ভ্যাকসিনের পেটেন্ট এবং জনস্বাস্থ্যের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা যেতে পারে। সে লক্ষ্যেই বাইডেন প্রশাসনের মওকুফের বিবৃতি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনার আগ্রহ পেটেন্ট মওকুফের দিকে এগিয়ে গেলেও পেটেন্ট ছাড়ের প্রস্তাবটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ১৬৪ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ট্রিপস কাউন্সিলে সর্বসম্মতভাবে পাস হতে হবে। গত ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে এটি অনুমোদিত হয়নি; পরবর্তী সভায় প্রস্তাবটি বিবেচনায় আলোচনা অব্যাহত রাখতে সম্মত হন। প্রস্তাবটির পৃষ্ঠপোষকরা ঘোষণা করেছেন, তারা একে অপরের কাছাকাছি অবস্থানে পৌঁছাতে ২০২০ সালের অক্টোবরে জমা দেওয়া পাঠ্যের সংশোধিত প্রস্তাব নিয়ে আসবে।
তবে কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের অস্থায়ী পেটেন্ট মওকুফের সিদ্ধান্তের মধ্যে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর ভ্যাকসিন প্রযুক্তি স্থানান্তর, এ কোম্পানিগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া এবং কাঁচামাল সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যদি ভ্যাকসিনগুলোর পেটেন্ট নেওয়া হয়, তবে তাদের কাছে ভ্যাকসিন প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পর্কে সমস্ত তথ্য থাকতে পারে এবং কাঁচামাল পাওয়ার পরে তারা ভ্যাকসিন তৈরি ও সরবরাহ করতে পারে। এ ছাড়া কাঁচামাল পাওয়া গেলে তাদের বিদ্যমান আইনের অধীনে তারা ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহ করার জন্য বাধ্যতামূলক লাইসেন্সও দিতে পারে। তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বা তাদের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় আসীন না হওয়া পর্যন্ত বা আগে যেটি হয় সে পর্যন্ত ভ্যাকসিনসহ ওষুধের পেটেন্ট দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কাজেই ওষুধের পেটেন্ট ব্যবস্থা না থাকায় বা স্বেচ্ছায় লাইসেন্সের অভাবে দেশগুলোর কাছে ভ্যাকসিনের প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিজ্ঞান থাকবে না এবং তারা ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারবে না।
সুতরাং যদি কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের স্বল্পমেয়াদি পেটেন্ট মওকুফের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, এটি সরাসরি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করবে যারা বাধ্যতামূলক লাইসেন্স ছাড়াই স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোকে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সরবরাহের অনুমতি দিতে পারে। তদুপরি, যদি তারা অন্তর্বর্তী পেটেন্ট মওকুফের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বা এমনকি নির্ধারিত নিয়ম, পদ্ধতিসহ বাধ্যতামূলক লাইসেন্সের মাধ্যমে ভ্যাকসিন তৈরি করে, তখন তারা স্বল্পোন্নত দেশসহ অন্যান্য দেশে সরবরাহ করতে পারে। এর অর্থ হলো, কভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলোর অস্থায়ী পেটেন্ট মওকুফের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো সমান্তরাল আমদানির মতবাদ ব্যবহার করে সস্তা জায়গা থেকে ভ্যাকসিন আমদানিতে অপ্রত্যক্ষভাবে সুবিধা পাবে।
তবে যদি কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের অস্থায়ী পেটেন্ট মওকুফের সিদ্ধান্তের মধ্যে ২০০১ সালে জনস্বাস্থ্যের দোহার ঘোষণাপত্রের চেয়ে আরও নমনীয় শর্তে ভ্যাকসিন প্রযুক্তি, প্রযুক্তিজ্ঞান এবং কাঁচামালগুলো স্থানান্তর করার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো সরাসরি উপকৃত হবে। এ ছাড়া যদিও এটি সময়সাপেক্ষ, কাঁচামাল খুব কম এবং ব্যয়বহুল, দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের পরীক্ষাগারগুলোতে ভ্যাকসিনগুলোর অণুগুলো শনাক্ত করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় প্রটোকল এবং নিয়ন্ত্রণবিধি অনুযায়ী জেনেরিক তৈরির মাধ্যমে ভ্যাকসিনগুলো সহজলভ্য করতে পারে।
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়