অর্থ পাচার নিয়ে গত সোমবার জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নতুন করে যেভাবে সামনে আসছে, তাতে প্রশাসন নতুন করে তৎপর হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। বুধবার সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, অর্থ পাচারকারীদের তথ্য জানতে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক ১০ দেশে অর্ধশত চিঠি পাঠালেও কোনোটিরই জবাব পায়নি। এরপরও দুদক পরবর্তী কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নির্লিপ্ত ছিল কেন? সংশ্নিষ্টরা যদিও বলছেন, দুদকের বিদ্যমান সামর্থ্য ও সক্ষমতা দিয়ে পাচারকারীদের তথ্য ও পাচার অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়। অথচ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার মাধ্যমে অতীতে কীভাবে পাচার অর্থ ফেরত আনা হয়েছে, সে উদাহরণও আমাদের রয়েছে। যদিও আমরা মনে করি. পাচার হয়ে যাওয়ার পর অর্থ ফেরত আনা যত কঠিন, পাচারের পথ বন্ধ করা তার চেয়েও সহজ। এখানেই আমাদের জোর দেওয়া জরুরি। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিষেধক সবসময়ই উত্তম। পাশাপাশি অর্থ পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা চাই। সোমবার জাতীয় সংসদের আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কারা টাকা পাচার করছে, সে তালিকা নাকি তার কাছে নেই। তার কাছে যদি তালিকা না থাকে, তবে কার কাছে থাকবে?

আমরা জানি, অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট আছে। আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও। এসব প্রতিষ্ঠান তাহলে কী করছে? সমকালের প্রতিবেদনেই এসেছে, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট পাঁচ বছরে ১ হাজার ২৪টি পাচারের ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যেখানে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি, সেখানে দেখা গেছে অর্থ পাচারের তথ্য দুদক, পুলিশ, সিআইডি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো হলেও খুব কম ক্ষেত্রেই তদন্ত কিংবা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে পাচারকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট যে, অর্থ পাচারের ঘটনার সঙ্গে বিশেষত রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় এসেছে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুল। যদিও তিনি সাংসদ থাকা অবস্থায় মানব পাচার, ভিসা জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাংলাদেশের সংসদ সদস্য পদ হারান। আলোচনার জন্ম দিয়েছেন পি কে হালদারও। যিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলের পর সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় বহাল তবিয়তে। সম্প্রতি নাটোরের একজন সংসদ সদস্য স্ত্রীর নামে কানাডায় বাড়ি কেনার তথ্যও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক নানা মাধ্যমেও প্রকাশ পায়।

বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচার ও অবৈধ অর্থ লেনদেনবিষয়ক ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআইর তথ্যে যেমন বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বিষয়টি এসেছে, তেমনি কয়েক বছর আগে পানামা প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতেও দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ হয়েছে। এ পর্যন্ত অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও অধিকাংশই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অর্থ পাচারকারী বড় বড় অপরাধীদের শাস্তি হলে ছোট অপরাধী, বিশেষ করে যারা ভবিষ্যতে অর্থ পাচারে আগ্রহী, তাদের কাছেও যাবে সতর্ক বার্তা। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর দেশের বাইরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বার্থেই পাচারের এ ধারা বন্ধ করতে হবে।

বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলো পাচার অর্থ ফিরিয়ে আনতে যেহেতু ব্যর্থ হচ্ছে, সরকার এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিতে পারে। একই সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্ভাব্য সব পথ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া চাই। ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার ও আমদানি খাতে দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে দেশে অর্থ বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে যে শঙ্কা রয়েছে তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা বিশ্বাস করি, অর্থ পাচার বন্ধে সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে। এখন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার প্রমাণ আমরা দেখতে চাইব।