আজকের শিশুরা আগামী দিনে বিশ্বে নেতৃত্ব দেবে। তাই তাদের সুষ্ঠু বিকাশ অপরিহার্য। পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও সমাজে শিক্ষা, বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে শিশুরা মানসিক ও শারীরিকভাবে বিকশিত হবে এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। তবে অনেক শিশুই এই প্রত্যাশিত জীবনের ছোঁয়া পায় না। অর্থনৈতিক চাপ ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে অল্প বয়সেই অভিশপ্ত শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হয় তারা। যে বয়সে তাদের বই হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা যুক্ত হয় যাবতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। অনেক সময় শিশুদের জোরপূর্বক এসব কাজে যুক্ত করা হয়। এর ফলে জীবনের উষালগ্নেই নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যু ঘটছে অনেকের।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক শোষণের এক দীর্ঘস্থায়ী হাতিয়ার হলো শিশুশ্রম। আমরা জানি- অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক বৈষম্য ও অস্থিরতা একই সঙ্গে কর্মহীনতার মতো দারিদ্র্য সৃষ্টিকারী শর্তগুলো শিশুশ্রমের জন্য দায়ী। আবার কিছু অভিভাবকের অসচেতনতা, নিজেদের অলসতা, নেশাগ্রস্ততা ও পারিবারিক কলহ শিশুদের এই পথে ঠেলে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে মালিক বা দালালদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করে শিশুদের পাঠিয়ে দেয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুরা শ্রমিক হিসেবে যুক্ত হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। এর ফলে তাদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো শ্রম সংক্রান্ত বিভিন্ন আওতার বাইরে থেকে যায়। তাতে সুবিধা হয় নিয়োগকর্তাদের। কারণ এই শিশুরা বাধ্যগত, নমনীয়, অসংগঠিত ও দাবি-দাওয়ার বিষয়ে অসচেতন। এই সুযোগে বড়দের কাজ তাদের মাধ্যমে করিয়ে নেয় মুনাফালোভী গোষ্ঠী, বিনিময়ে মজুরি দেয় যৎসামান্য।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের 'চাইল্ড লেবার :গেল্গাবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরোয়ার্ড' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে বিশ্বজুড়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্য ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে।' প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'শুধু গত চার বছরে প্রায় ৮৪ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯-এর কারণে ২০২২ সালের মধ্যে আরও ৯০ লাখ শিশু একই ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।' আইএলওর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০০ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৯ কোটি চল্লিশ লাখে নেমে এসেছিল। গত চার বছরে উদ্বেগজনকভাবে এ চিত্র পাল্টে গেছে। শিশু শ্রমিকের আনুমানিক এই সংখ্যা নিঃসন্দেহে একটি সতর্কবার্তা।

আমাদের দেশে প্রায় সর্বত্রই শিশু শ্রমিক পরিলক্ষিত হয়। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি খাতে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ শিশু শ্রমে জড়িত। আইএলওর তথ্যমতে, শুধু ঢাকাতেই দেড় লাখেরও বেশি শিশু বিপর্যয়কর কাজের সঙ্গে জড়িত। বাস্তবে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের দেশে শিশুরা সাধারণত কৃষি, কল-কারখানা, গণপরিবহন, বাসাবাড়ি, খাবারের দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা ও নির্মাণকাজে শ্রম বিক্রি করে থাকে। অনেক সময় মাদক সম্রাটদের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় তাদের। এর ফলে অন্ধকারে হারিয়ে যায় এই শিশুদের ভবিষ্যৎ। কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয় তারা। অসুস্থ হলে সামান্য চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকারও তাদের থাকে না। অনেক কন্যাশিশু অল্প বয়সেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এক পর্যায়ে এই শিশুদের অনেকেই মাদকের কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

আমাদের দেশে শিশুশ্রম রোধে কঠোর আইন থাকলেও সেগুলো বাস্তবায়নে নেই কঠোরতা। আমাদের পেনাল কোডে বিভিন্ন ধারায় শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা আছে। আছে শ্রম আইন, নূ্যনতম মজুরি আইন। এসব আইন কার্যকর থাকলে শিশুশ্রম প্রথা জিইয়ে থাকতে পারত না। কভিড পরিস্থিতির উন্নতি, শিশুদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা এবং সামাজিক বৈষম্য না কমলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আরও আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। আমরা কোনোভাবেই আগামী প্রজন্মকে এই বিপদে ফেলতে পারি না। সর্বশক্তি ব্যয় করে দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের এই দুষ্টচক্রকে ভাঙতে হবে। আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে শিশুশ্রম প্রতিরোধ করব- এটাই হোক আজকের অঙ্গীকার।

সাংবাদিক
saifulksg@gmail.com