
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, আমাদের প্রিয় 'খলীক স্যার' এদেশের আরও অনেকের মতো 'দুই জন্মদিন প্রপঞ্চ' এড়াতে পারেননি। তার 'দাপ্তরিক' জন্মদিন ১২ মার্চ (১৯৪৩) সবারই জানা। কিন্তু আমরা কেউ কেউ জানি, তার প্রকৃত জন্মদিন একই বছরের ১২ জুন। তার পিতা মৌলানা কাজী মুফজ্জল হুসেন ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের আসাম গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য বা এমএলএ। দেশ ভাগের পর রাজনীতি ছেড়ে অধ্যাপনায় যোগ দেওয়া পিতার কাছেই শৈশব-কৈশোরের পড়াশোনা করে মৌলভীবাজার পোর্টিয়াস উচ্চ বিদ্যালয়ে একবারে অষ্টম শ্রেণিতে যখন ভর্তি হতে যান, তখনই প্রকৃত ও দাপ্তরিক জন্মদিনের এই পার্থক্য তৈরি হয়েছিল।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ধ্রুপদি যুগের অর্থনীতিবিদদের একজন। কিন্তু তিনি চার দেয়ালে বন্দি বা নথির স্তূপে চাপা পড়ে থাকেননি। সেই ষাটের দশকে যারা বাঙালির স্বতন্ত্র 'রাজনৈতিক অর্থনীতি' নিয়ে সক্রিয় ছিলেন, তিনি তাদের একজন। যে কারণে তখনকার মেধাবী ও কৃতী শিক্ষার্থীদের 'ট্রেন্ড' বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা সিএসপি কর্মকর্তা হওয়ার হাতছানি উপেক্ষা করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ষাটের দশকের গোড়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থিত তৎকালীন পিআইডিইতে যোগ দেন। বরেণ্য অর্থনীতিবিদ স্বদেশ বোসের নেতৃত্বে যারা পিআইডিইর সদর দপ্তর করাচি থেকে ঢাকায় স্থানান্তরে তৎপর ছিলেন, কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ তাদের একজন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে যখন তা সম্ভব হয়, ততদিনে পূর্ববঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ঘণ্টা বেজে গেছে। এই প্রতিষ্ঠানই প্রথমে বিআইডিই এবং পরে বিআইডিএস নাম গ্রহণ করে। আশির দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন এর গবেষণা পরিচালক।
একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে যেমন মিছিলে পা ও জনসভায় কণ্ঠ মেলাতেন, তেমনই দাপ্তরিক বিভিন্ন তথ্য অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কাছে পৌঁছে দিতেন। তার কাছ থেকে পেতেন বঙ্গবন্ধু। ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরুর পর ২৭ মার্চ প্রাণ হাতে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে কলকাতায় পৌঁছেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সেলে যুক্ত হন।
প্রশ্ন হচ্ছে, অন্যান্য অর্থনীতিবিদ থেকে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের স্বাতন্ত্র্য কী? আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ মতে- তিনি জটিল সব তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিষয় সহজ করে বলতে পারেন। সে হোক অর্থনীতি বা জলবায়ু পরিবর্তন- সাধারণ মানুষের উপযোগী করে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিতে তার জুড়ি নেই।
চিন্তা ও তৎপরতায়ও কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জনমানুষকেই সবসময় সামনে রাখেন। ক্ষুদ্রঋণ যখন উন্নয়নের 'ধন্বন্তরী' ব্যবস্থা হিসেবে দেশে-বিদেশে বিবেচিত হচ্ছিল, তখনই যারা এই ব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর ধরিয়ে দেওয়ার 'সাহস' করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। উন্নয়ন যে নিছক 'কাঁচা টাকা' হাতে আসার বিষয় নয়; বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার বিষয়, সে বিষয়ে তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করে তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছেন এবং পিকেএসএফের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে হাতেকলমে প্রমাণ করে চলছেন।
খলীক স্যারকে আমি কাছ থেকে দেখছি প্রায় দুই দশক। সভা-সেমিনারে তার বক্তব্য শুনেছি, একসঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভ্রমণও করেছি। চার দেয়াল থেকে খোলা প্রান্তর- সবখানেই দেখেছি, তার অগ্রাধিকারে থাকে সাধারণ মানুষ। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন, তাদের কাছ থেকেই প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে চান। সেই সত্তরের দশকে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের পিএইচডি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ কৃষকের সঙ্গে যেন কৃষক হয়ে, শ্রমিকের সঙ্গে যেন শ্রমিক হয়ে মিশে যেতে পারেন- এই গুণ খুব কম অর্থনীতিবিদের মধ্যে দেখেছি।
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের এই 'স্টাইল' মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত। তিনি সবসময়ই বলেন ও লেখেন- আমাদের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে যে সাম্য, মর্যদা ও ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত মুক্তি সেই পথেই সম্ভব। গত কয়েক বছরে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর অনেক রচনা, বক্তব্য ও বিবৃতি থেকে আমরা জানি, তিনি কীভাবে প্রায়শই তার 'দুখী মানুষ' নিয়ে ভাবতেন। অথচ খলীক স্যারের কাছে আরও আগে আমি প্রথম 'বঙ্গবন্ধুর দুখী মানুষ' ধারণার কথা শুনেছিলাম। হতে পারে, সেখান থেকেই তিনি নিজেকে 'দুখী মানুষের অর্থনীতিবিদ' হিসেবে গড়ে তোলার প্রেরণা পেয়েছেন। তাদের জন্য সাম্য, মর্যদা ও ন্যায়বিচারের বাণী বুকে ধারণ করেছেন। ঠিক যেমন লালন করে চলেছেন নিজের দীর্ঘ কেশরাজি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস চুল না কাটার ফলে সেই যে দীর্ঘ হয়েছিল, আর খাটো করেননি।
আরেকটি কথা বলতেই হবে। তরুণদের প্রতি কাজী খলীকুজ্জমানের আস্থা ও পক্ষপাতিত্ব। অর্থনীতি ও পরিবেশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই মেরুর বাসিন্দা। কিন্তু তার কাছে দুই মেরুর তরুণরাই প্রশ্রয় পায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশ্নে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয় ভুলে না যাওয়ার কথাও তিনি দশকে দশকে নীতিনির্ধারকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। সার্বিক নদী আন্দোলন বা নদী, জলাভূমি ও পানিসম্পদ বিষয়ক নাগরিক সংগঠন রিভারাইন পিপলের দর্শন ও কার্যক্রমে তার অবদান অবিস্মরণীয়। জন্মদিনে খলীক স্যারকে সবার পক্ষ থেকে জানাই নদীময় শুভেচ্ছা।
লেখক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
মন্তব্য করুন