
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার লড়াইটা বাহ্যত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল দুই জাতীয়তাবাদের মধ্যে। হিন্দু জাতীয়তাবাদ বনাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে জয় বাংলা। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিকে একদা আগ বাড়িয়ে ডেকে এনেছিলেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে এবং জোর গলায় 'জয় বাংলা' আওয়াজ দিয়ে। ইতিহাসের এটা একটা মজাদার কৌতুক বটে। পশ্চিমবঙ্গ আজ চাইছে তার বাঙালিত্বকে রক্ষা করতে, কারণ সেটি এখন বিপন্ন; এবং বিপদটা তথাকথিত 'মুসলিম বাংলাওয়ালা'দের কাছ থেকে আসেনি, এসেছে সেদিন যারা ভাগ করে হলেও বাংলাকে নিজেদের মনগড়া মুসলিম বাংলার হাত থেকে বাঁচাবেন বলে অখণ্ড বাংলাকে কেটে দু'ভাগ করার সর্বনাশা খেলায় মেতেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছেন, কট্টর সেই হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকেই। পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতা না পেলেও এটা ভেবে অবশ্যই সন্তুষ্ট হতে পারে যে, রাজনীতিতে সেই পুরাতন সাম্প্রদায়িকতাকে, বলা যায় দ্বিজাতিতত্ত্বকেই তারা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। ভারতকে উনিশশ সাতচল্লিশ তো বটেই, তারও আগের অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। সবটা এখনও পারেনি, তবে আশা করতে থাকবে আগামীতে ওই রাজনীতিকে আরও উগ্র করে তুলে শ্রেণিবিভাজনের সত্যটাকে অবলুপ্ত করে দিয়ে ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।
তবে আমরা অবশ্য নিশ্চিত যে, সেটা সম্ভব হবে না। প্রথম কারণ ভারত এক জাতির দেশ নয়, কখনও ছিল না, এখনও নয়। ভারতে বহুজাতির বসবাস এবং প্রত্যেকটি জাতিরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। হিন্দু ও মুসলিম, এরা দুটি আলাদা সম্প্রদায় ঠিকই; কিন্তু আলাদা জাতি নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ক্ষোভের একটা বড় কারণ হিন্দির আক্রমণ। বিজেপির শীর্ষ নেতারা পশ্চিমবঙ্গে এসে হিন্দি ভাষায় বক্তৃতার তুফান ছুটিয়েছেন, বাঙালি সেটা পছন্দ করেনি। বাঙালিপ্রীতি দেখাতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, শুনে বাঙালি কানে আঙুল দিয়েছে, কারণ সেটা কেবল বিকৃত নয়, অশ্নীলও শুনিয়েছে। আগের দিনে একটা গল্প চালু ছিল, যার সারমর্ম হলো, রবীন্দ্রনাথ ১৯৪১ সালে মারা যাওয়ার আগেও একবার মারা গিয়েছিলেন। কোনোমতে সেরে উঠেছিলেন। আর সেটা ঘটেছিল এক হিন্দিভাষীর প্রচণ্ড রবীন্দ্রপ্রীতির কারণেই। হিন্দিভাষী ওই ভদ্রলোক ছিলেন অপ্রতিরোধ্য কবিতাপ্রেমিক, তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ করেছেন এবং প্রফুল্লচিত্তে তা রবীন্দ্রনাথকে শোনাতে গিয়েছিলেন। সেই যে চরণ রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির, 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধুলার তলে', তার অনুবাদ তিনি করেছিলেন 'পাটক দে মেরি শির তেরি টেঙরি পর'। আর সেটা শুনে অমন ধৈর্যশীল মানুষ যে, রবীন্দ্রনাথের হৃদকম্প স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতো হয়েছিল। হিন্দি বাংলায় এই তফাৎটা খুবই স্বাভাবিকভাবে ঘটে, আর ওই স্বাভাবিকতাই তো জানিয়ে দিচ্ছে, দুটিকে এক করতে চাওয়াটা ভীষণ বিপজ্জনক। ভারতবর্ষের যে ঐক্য রবীন্দ্রনাথও কল্পনা করতেন, সেটা রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কোনো পর্যায়েই অর্জন সম্ভব ছিল না, বরঞ্চ বৈচিত্র্যের মাঝে যে ঐক্য গড়ে ওঠে তা মেনে নেওয়াটাই ছিল বাস্তবসম্মত। কেউ কেউ অবশ্য সেটা মানেন না। না মেনে বিপদ ডেকে আনেন সাধারণ মানুষের জন্য, যাদের তারা নেতা সেজে বসে আছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে শেষ পর্যন্ত 'জয় বাংলা'র শরণাপন্ন হয়েছেন, সেটা একটা শুভ সংকেত বৈকি। ওই আওয়াজ তুলেই আমরা পূর্ববঙ্গের মানুষেরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করেছিলাম। পাকিস্তান এক জাতির দেশ ছিল না। সেখানে অন্তত পাঁচটি জাতি ছিল, উর্দুভাষী মোহাজেরদের বাদ দিয়েও সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে যে মূল্যটা আমাদের দিতে হয়েছে, ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। ভারতবর্ষের বাস্তবতাও বলছে, যে-পন্থাতেই হোক না কেন, সেখানকার জাতিসমূহকে অবশ্যই একটা মীমাংসায় আসতে হবে, এমন মীমাংসা যাতে প্রত্যেকটি জাতি নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে উন্নত হতে পারে, একের উন্নতি অন্যের অবনতির কারণ না হয়ে এবং মূল সমস্যা যেটি- শ্রেণি সমস্যা, সেটি যাতে বের হয়ে আসার এবং মীমাংসার পথ খুঁজে পায়।
মমতা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে আপাতত টিকে গেলেন; তবে তিনি যে ওতেই সন্তুষ্ট থাকবেন তা নয়। তাঁর দৃষ্টি দিল্লির দিকেও প্রসারিত থাকবে। সেটি খুবই স্বাভাবিক। চলো চলো দিল্লি চলো, এটা তো বাঙালি অনেককাল ধরেই বলে আসছে। এবারের নির্বাচনেও তৃণমূলের যেসব নেতাকর্মী দলত্যাগ করে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন, তারা দিল্লি থেকে কিছু পাবেন এমন আশা বক্ষমাঝে লালন করেছেন। মমতার নিকটতম সহকর্মীদের একজন, নন্দীগ্রাম-বিজয়ী বলে যিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন, সেই ব্যক্তি যে দল ছাড়লেন, কেবল ছাড়লেনই না নিজের নেত্রীকে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়ে আরেকটি রেকর্ড সৃষ্টি করলেন, তারও নাকি আশা ছিল দিল্লির প্রসাদপুষ্ট হয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আসনে আসীন হওয়ার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য টের পেলেন যে, বাঙালির জন্য দিল্লি সত্যি সত্যি অনেক দূরের রাস্তা। কংগ্রেসের প্রয়াত জ্যেষ্ঠনেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় দিল্লির সংলগ্ন হতে সক্ষম হয়েছিলেন, এমনকি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও হতে পেরেছিলেন; কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর হওয়া হয়নি। আক্ষেপ করে বলেছেন, তার ওই ব্যর্থতার মূল কারণ হিন্দি ভাষাটা ভালো না জানা। মমতা যদি দিল্লি দখল করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মনস্কামনা পূরণ করতে না পারেন, তবে তার একটা কারণ হয়তো হবে হিন্দি ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করতে না পারা। হিন্দি অবশ্য তিনি কিছুটা আয়ত্তে এনেছেন, ভবিষ্যতে হয়তো তার অর্জনকে অধিকতর উন্নত করতে সক্ষম হবেন, কিন্তু বাঙালির হিন্দি সে তো আর খাঁটি জিনিস না, সেটা কৃত্রিম থাকতে বাধ্য।
দিল্লি থাকুক। মমতাকে আমরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই দেখতে পাচ্ছি। সেটাই বা কম কিসে? তবে তার জোরটা যে কমে আসতে থাকবে তা নিশ্চিত। বিজেপির হট্টগোল ও হস্তক্ষেপ তো থাকবেই, নিজের দলের বলবানদের আশা পূরণ করাও কঠিন হবে। আর যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পতাকা ও 'জয় বাংলা' ধ্বনিকে মমতা লড়াইয়ের মূল শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন সেই দুটির প্রতি তার কতটা আনুগত্য তারও পরীক্ষা আগামীতে তাকে দিতে হবে বৈকি। বাংলাদেশের দিক থেকে তার বাঙালিত্বের পরীক্ষাটা হয়ে যাবে তিস্তার পানি বিতরণের অপেক্ষমাণ প্রশ্নেই। নদীর জলপ্রবাহ বাঙালির অর্থনীতি ও সংস্কৃতি উভয়ের জন্যই বিশেষ অবলম্বন, তাকে প্রাণপ্রবাহ বললেও অতিশয়োক্তি করা হবে না। সেই প্রবাহ তিনি স্বহস্তে রুদ্ধ করে রাখবেন, আর এপারের বাঙালি তাকে বাঙালির খাঁটি বন্ধু হিসেবে দেখবে এবং তার বাঙালিত্বের দাবিটিও অবিকৃত থাকবে- এতটা নিশ্চয়ই আশা করা যায় না। আমরা আশা করতে পারি, বাঙালি জাতীয়তাবাদে নব্যদীক্ষিত মমতা কিছুটা নরম হবেন, কিন্তু ভরসা করার কোনো কারণ দেখি না। ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের জন্য মমতার বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরীক্ষা বেশ পরিস্কারভাবেই ঘটবে, যখন দেখা যাবে কোন বাঙালির তিনি আপনজন, শতকরা ১০ জন সুবিধাভোগীর (তার দলের লোকসহ) নাকি বাকি ৯০ জনকে মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর? বাস্তবতার দাপটে এটা নিশ্চিত না ঘটে উপায় নেই যে, তিনি ১০ জনের হয়েই কাজ করবেন। সে ক্ষেত্রে তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও 'জয় বাংলা' আওয়াজ উভয়ই ক্রমশ ফিকে হয়ে আসবে। দেখা যাবে যে, তার নিজের ও তার দলের সঙ্গে বিজেপির যে প্রকাণ্ড-প্রচণ্ড বিরোধ তার অন্তরালে দু'পক্ষের মধ্যে শত্রু নয়, ভীষণ অন্তরঙ্গতাই বিদ্যমান, যে অন্তরঙ্গতার ভিত্তি হলো বস্তুগত স্বার্থ। তারা বিবদমান উভয় পক্ষই পুঁজিবাদী উন্নতির সমর্থক এবং সুবিধাভোগী মানুষদের সুবিধা দেখভাল করার দায়িত্বে স্বেচ্ছায় নিয়োজিত। লড়াইটা ক্ষমতার। যুদ্ধটা ভাইবোনের। তাই বলে বাঙালি জাতীয়তাবাদটা যে মিথ্যা, তা তো নয়।
পশ্চিমবাংলার বাঙালিকে মুক্ত করতে হলে কেন্দ্রের অন্যায় আধিপত্য থেকে যেমন বেরিয়ে আসা চাই, তেমনি চাই অভ্যন্তরীণ সামাজিক বিপ্লব; আর সে বিপ্লব অন্য কেউ করতে পারবে না, বামপন্থিরা ছাড়া। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ও মমতাপন্থিদের দাপটে বামপন্থিরা তো এখন বড়ই দুর্দশার মধ্যে আছেন, কাদার ভেতরে আশ্রয় নিয়েছেন গরমকালের মাছের মতো। আশা এই যে, অচিরেই তারা বের হয়ে আসবেন এবং জনবিচ্ছিন্ন না থেকে গভীরভাবে জনসংলগ্ন হবেন। একটা বড় মুশকিল এই যে, তাদের কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না; জাতীয়তাবাদীরা যা বলে লোকে সেটা বোঝে। কারণ তাদের কথাগুলো সোজাসাপ্টা, চাঁছাছোলা। বামপন্থিদের কথা সে-রকম পরিস্কার নয়। এর কারণ তারা যা বলতে চান তা সরল নয়, কিছুটা তাত্ত্বিক। তার চেয়েও বড় সত্য হলো, তারা যা বলতে চান সেটা তাদের নিজেদের কাছেও খুব স্পষ্ট থাকে না। ভীষণ অভাব রয়েছে অনুশীলনের। কমিউনিস্টরা জ্ঞানে, আবেগে, রুচিতে বুর্জোয়াদের চেয়ে উন্নত হবেন এবং বুর্জোয়ারা যা করতে পারেন না, সেটা করতে পারবেন- এমনটাই প্রত্যাশিত। রাশিয়া ও চীনে যে বিপ্লব ঘটেছে তার পেছনে ব্যাপক ও গভীর সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি ছিল; সেটা না থাকলে বিপ্লব কিছুতেই সম্ভব হওয়ার নয়।
শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক
মন্তব্য করুন