- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বহুমুখী আবিদ আনোয়ার
বহুমুখী আবিদ আনোয়ার

আজ ৭০ বছরে পা রাখলেন আবিদ আনোয়ার। তার মুকুটে অনেক পালক- কবি, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, কথাসাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা। এ উপলক্ষে আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে স্মারক গ্রন্থ 'বহুমুখী আবিদ আনোয়ার'। গ্রন্থটি সম্পাদনা করতে পারা আমার জন্য আনন্দ ও সম্মানের।
আবিদ আনোয়ার স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে শ্রেষ্ঠতম নাম। প্রকৃত সাহিত্যস্রষ্টা ইচ্ছা করেও কখনোই নিভৃতচারী হতে পারেন না; সময় তার নিজের প্রয়োজনেই তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করে। আবিদ আনোয়ার নিজেকে প্রায় লুকিয়ে রেখে আপনমনে কেবল তার সৃষ্টিকর্মেই নিমগ্ন থাকার চেষ্টা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কর্মোপলক্ষে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ঢাকার বাইরে আর উচ্চশিক্ষার জন্য কিছুকাল যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু আমাদের সাহিত্যজগতের 'দিকপাল' বলে পরিচিত নমস্য গুরুজন থেকে মেধাবী তরুণ- কারও নজর এড়ায়নি আবিদ আনোয়ারের রচনাকর্মের উৎকর্ষ।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র 'আবিদ আনোয়ারের কবিতা' শীর্ষক এক আলোচনা সভা আয়োজন করেছিল, আমি নিজেও ছিলাম আলোচক। সেই সভায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সভাপতির ভাষণে বলেন, 'বড় কবিদের রচনা পড়লে আমরা তাদের একটা নিজস্ব জগতে প্রবেশ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা জীবনানন্দ দাশ প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ কাব্যজগৎ। আবিদ আনোয়ারের কবিতা সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কথা : তিনি তার কবিতার মাধ্যমে আমাদের একটা নতুন জগৎ উপহার দিতে পেরেছেন।'
শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, আনিসুল হক, মাহবুব সাদিক, অসীম সাহা, রফিকউল্লাহ খানসহ সব প্রজন্মের মেধাবী লেখক-আলোচকরা আবিদ আনোয়ারের রচনাকর্মের উৎকর্ষ নিয়ে অকুণ্ঠচিত্তে লিখেছেন।
আবিদ আনোয়ার কেবল কবি নন। কবিতা বিষয়ে এমনসব বিশ্নেষণাত্মক প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে তার, যেগুলো প্রচলিত অধ্যাপকসুলভ আলোচনার বাইরে গিয়ে নতুন ভাবনার উদ্রেক করে। এই মৌলিকত্বের জন্য দুই বাংলার সাহিত্যের অধ্যাপক থেকে শুরু করে নবীন কবিতাকর্মী সবার কাছেই নন্দিত তার 'বাঙলা কবিতার আধুনিকায়ন', 'চিত্রকল্প ও বিচিত্র গদ্য', 'বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা'। বিশেষত 'ছন্দের সহজপাঠ', যাতে ব্যবহূত হয়েছে সহজে ছন্দ শেখার জন্য 'থুতনি পদ্ধতি' নামে এক মজার কৌশল। বাংলা ছন্দশাস্ত্রে এ এক নতুন সংযোজন। বহুকাল ধরে বাংলা ভাষায় জাপানি ক্ষুদ্র কবিতা হাইকু রচনা করেছেন অনেকেই যে যার মতো করে। মূল জাপানি হাইকু-তে ৫-৭-৫ মাত্রার পঙ্ক্তিবিন্যাসের কথা সবাই কমবেশি জানেন। কিন্তু আবিদ আনোয়ারই প্রথম এই প্রাকরণিক শুদ্ধতা রক্ষা করে বাংলায় হাইকু লিখেছেন। একটি নিবন্ধে ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্নেষণ করে অন্যদের শিখিয়েছেন যে, বাংলা ছন্দে ৫ ও ৭ মাত্রার পর্বের অস্তিত্ব আছে কেবল মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তাই স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দে প্রকরণসিদ্ধ হাইকু লেখা সম্ভব নয়। এতে তিন-পঙ্ক্তির ধ্বনিমাধুর্য্য মার খায়। ছড়া ও গান রচনায় তিনি আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠদের একজন। 'তিন পাখনার প্রজাপতি' নামে তার একটি ছোটগল্পের বইও প্রকাশিত হয়েছে মাওলা ব্রাদার্স থেকে। তাই নির্দি্বধায় বলা চলে, মূলত কবি হলেও আবিদ আনোয়ার সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই বিচরণশীল এবং সমানভাবে নন্দিত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের চাকুলিয়া ক্যাম্প থেকে বিস্টেম্ফারক বিশেষজ্ঞ কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবিদ আনোয়ার ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে কিশোরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। ধুলদিয়া রেল সেতু, মানিকখালী রেল কালভার্ট অপারেশনসহ বহু গেরিলা অপারেশন ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বিধ্বস্ত রেল সেতুর দখল ধরে রাখতে একপর্যায়ে কিশোরগঞ্জের গোটা হাওর এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যস্ত করা হয়েছিল তার অধীনে। যুদ্ধের পর একপর্যায়ে গোটা কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিফ কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কাজে তার পূর্বসূরি ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও লে. সাদেক। মহকুমা ক্যাম্পের তৎকালীন চেয়ারম্যান (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি) অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ তার প্রত্যয়নপত্রে লিখেছেন, কিশোরগঞ্জের যুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল একজন সাব সেক্টর কমান্ডারের সমতুল্য। তার যুদ্ধের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে আগামী প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত 'আমার মুক্তিযুদ্ধ :রাজপথ থেকে রণাঙ্গন' বইটিতে।
উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি
আবিদ আনোয়ার স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটে শ্রেষ্ঠতম নাম। প্রকৃত সাহিত্যস্রষ্টা ইচ্ছা করেও কখনোই নিভৃতচারী হতে পারেন না; সময় তার নিজের প্রয়োজনেই তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অভিষিক্ত করে। আবিদ আনোয়ার নিজেকে প্রায় লুকিয়ে রেখে আপনমনে কেবল তার সৃষ্টিকর্মেই নিমগ্ন থাকার চেষ্টা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কর্মোপলক্ষে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ঢাকার বাইরে আর উচ্চশিক্ষার জন্য কিছুকাল যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু আমাদের সাহিত্যজগতের 'দিকপাল' বলে পরিচিত নমস্য গুরুজন থেকে মেধাবী তরুণ- কারও নজর এড়ায়নি আবিদ আনোয়ারের রচনাকর্মের উৎকর্ষ।
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র 'আবিদ আনোয়ারের কবিতা' শীর্ষক এক আলোচনা সভা আয়োজন করেছিল, আমি নিজেও ছিলাম আলোচক। সেই সভায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সভাপতির ভাষণে বলেন, 'বড় কবিদের রচনা পড়লে আমরা তাদের একটা নিজস্ব জগতে প্রবেশ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা জীবনানন্দ দাশ প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ কাব্যজগৎ। আবিদ আনোয়ারের কবিতা সম্পর্কে সবচেয়ে বড় কথা : তিনি তার কবিতার মাধ্যমে আমাদের একটা নতুন জগৎ উপহার দিতে পেরেছেন।'
শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, হুমায়ুন আজাদ, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, আনিসুল হক, মাহবুব সাদিক, অসীম সাহা, রফিকউল্লাহ খানসহ সব প্রজন্মের মেধাবী লেখক-আলোচকরা আবিদ আনোয়ারের রচনাকর্মের উৎকর্ষ নিয়ে অকুণ্ঠচিত্তে লিখেছেন।
আবিদ আনোয়ার কেবল কবি নন। কবিতা বিষয়ে এমনসব বিশ্নেষণাত্মক প্রবন্ধগ্রন্থ রয়েছে তার, যেগুলো প্রচলিত অধ্যাপকসুলভ আলোচনার বাইরে গিয়ে নতুন ভাবনার উদ্রেক করে। এই মৌলিকত্বের জন্য দুই বাংলার সাহিত্যের অধ্যাপক থেকে শুরু করে নবীন কবিতাকর্মী সবার কাছেই নন্দিত তার 'বাঙলা কবিতার আধুনিকায়ন', 'চিত্রকল্প ও বিচিত্র গদ্য', 'বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা'। বিশেষত 'ছন্দের সহজপাঠ', যাতে ব্যবহূত হয়েছে সহজে ছন্দ শেখার জন্য 'থুতনি পদ্ধতি' নামে এক মজার কৌশল। বাংলা ছন্দশাস্ত্রে এ এক নতুন সংযোজন। বহুকাল ধরে বাংলা ভাষায় জাপানি ক্ষুদ্র কবিতা হাইকু রচনা করেছেন অনেকেই যে যার মতো করে। মূল জাপানি হাইকু-তে ৫-৭-৫ মাত্রার পঙ্ক্তিবিন্যাসের কথা সবাই কমবেশি জানেন। কিন্তু আবিদ আনোয়ারই প্রথম এই প্রাকরণিক শুদ্ধতা রক্ষা করে বাংলায় হাইকু লিখেছেন। একটি নিবন্ধে ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্নেষণ করে অন্যদের শিখিয়েছেন যে, বাংলা ছন্দে ৫ ও ৭ মাত্রার পর্বের অস্তিত্ব আছে কেবল মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। তাই স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দে প্রকরণসিদ্ধ হাইকু লেখা সম্ভব নয়। এতে তিন-পঙ্ক্তির ধ্বনিমাধুর্য্য মার খায়। ছড়া ও গান রচনায় তিনি আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠদের একজন। 'তিন পাখনার প্রজাপতি' নামে তার একটি ছোটগল্পের বইও প্রকাশিত হয়েছে মাওলা ব্রাদার্স থেকে। তাই নির্দি্বধায় বলা চলে, মূলত কবি হলেও আবিদ আনোয়ার সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই বিচরণশীল এবং সমানভাবে নন্দিত।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের চাকুলিয়া ক্যাম্প থেকে বিস্টেম্ফারক বিশেষজ্ঞ কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে আবিদ আনোয়ার ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে কিশোরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। ধুলদিয়া রেল সেতু, মানিকখালী রেল কালভার্ট অপারেশনসহ বহু গেরিলা অপারেশন ও সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বিধ্বস্ত রেল সেতুর দখল ধরে রাখতে একপর্যায়ে কিশোরগঞ্জের গোটা হাওর এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যস্ত করা হয়েছিল তার অধীনে। যুদ্ধের পর একপর্যায়ে গোটা কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিফ কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কাজে তার পূর্বসূরি ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ও লে. সাদেক। মহকুমা ক্যাম্পের তৎকালীন চেয়ারম্যান (বর্তমানে রাষ্ট্রপতি) অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ তার প্রত্যয়নপত্রে লিখেছেন, কিশোরগঞ্জের যুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল একজন সাব সেক্টর কমান্ডারের সমতুল্য। তার যুদ্ধের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে আগামী প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত 'আমার মুক্তিযুদ্ধ :রাজপথ থেকে রণাঙ্গন' বইটিতে।
উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি
মন্তব্য করুন