- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন এবং একটি সেতু
স্বীকৃতি
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন এবং একটি সেতু

শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই মুক্তিসংগ্রামের যে প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ এগিয়ে যেতে থাকেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিকে, সেই সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় প্রতিকৃতি সিরাজুদ্দীন হোসেন। গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের যে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম রচিত হয়েছিল, তার প্রাতঃস্মরণীয় কাণ্ডারির নাম সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ কারণেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের মাত্র ছয়দিন আগে (১০ ডিসেম্বর) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর আল-বদর বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। যে শহীদদের পুণ্য রক্তধারায় আজ আমরা স্বাধীন, সেই রক্তসাগরে মিশে আছে এই প্রণম্য সাংবাদিকের রক্ত।
শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। স্বদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাতিকে রুখে দাঁড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিতে পত্রিকার পাতায় আর বক্তৃতার মঞ্চে প্রাণপণ সংগ্রাম-সাধনা করে গেছেন তিনি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে ধারা তৎকালীন সময়ে আমাদের সংগ্রামের পথ তৈরি করেছিল, দৈনিক ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে তিনি সেই ধারা সৃষ্টিকারীদেরই একজন। এ কারণেই তার কর্মমুখর জীবন কেবল জীবনীপাঠ্যই নয়, আমাদের ইতিহাসেরও একটি জরুরি অধ্যায়। ইতিহাসের এই বীর সাংবাদিক মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শরশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালে। নিজের মেধা আর প্রতিভার বলেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি স্বদেশের সংগ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। বহু বছর ধরেই লক্ষ্য করছি আমাদের শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের মধ্যে এমন একটি ধারণা জন্মেছে যে, দেশ নিয়ে ভাবার দায়িত্ব কেবল যারা রাজনীতি বা প্রশাসনে আছেন তাদেরই। অনেকেই সন্তানদের নিজেকে গড়ে নেওয়ার শিক্ষা দেন বটে কিন্তু নিজের অর্জনকে যে দেশের কল্যাণের কাজে লাগাতে হবে, সে শিক্ষাটি দিতে চান না। আমি নিজের একটি কাজের জন্য শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের মহৎ জীবনের অধ্যায়গুলোকে শিশুদের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। আর ঠিক এ জায়গাটিতেই আমার মনে হয়েছে, বর্তমান সময়ের সামাজিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে এমন মানুষদের জীবনীই নতুন প্রজন্মের কাছে বারবার তুলে আনা উচিত। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ শহীদ বুদ্ধিজীবী বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদদের সবার শৈশব-কৈশোর বা তারুণ্যই অতিবাহিত হয়েছে পরাধীনতার গ্লানি বহন করে। তাদের আত্মত্যাগের কারণেই সেই গ্লানি থেকে আজ আমরা মুক্ত। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জীবন থেকে হীরকখণ্ডগুলো তুলে আনা। তারই আলোকে আমাদের সামনের পথটুকু আলোকিত করে এগিয়ে চলা।
অনেকেই ভাবতে পারেন, মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শালিখা ইউনিয়নের শরশুনা বাজার সংলগ্ন চিত্রা নদীর ওপরে নতুন সেতুটির নাম শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নামে করলেই কি তার প্রতি আমাদের ঋণ শোধ হবে? না, হবে না। জীবনের বিনিময়ে তিনি যে আদর্শ আর সংগ্রামের পথ আমাদের দেখিয়ে গেছেন, সে ঋণ আমরা কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। কিন্তু তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সম্মানিত করতে পারব। তাছাড়া আরেকটি বিষয় আলোচনায় আনা খুব জরুরি। নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে কিশোর প্রজন্মের নানা নৈতিক স্খলনের বিষয়ে আজকাল আলোচনা উঠে এসেছে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের বক্তব্য ও লেখাতে দেখছি, তারা বলছেন- এই প্রজন্মের সামনে কোনো মহৎ প্রাণের দৃষ্টান্ত নেই। কথাটির সঙ্গে আমি সর্বাঙ্গে একমত নই। বরং বলা উচিত, আমরাই বর্তমান প্রজন্মের সামনে মহৎ প্রাণের মানুষদের তুলে ধরতে পারছি না। এ ব্যর্থতা আমাদের। যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সে গ্রামে জন্ম নেওয়া প্রতিটি প্রজন্মের কাছে তাকে তুলে ধরার সর্বোত্তম পন্থাটিই তো হতে পারে শরশুনা বাজার সংলগ্ন চিত্রা নদীর ওপরে নতুন সেতুটির 'শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন সেতু' নামকরণ। সেতুর ফলকে তার জীবনীভিত্তিক তথ্য থেকেই তো একজন কিশোর বা তরুণ তার বর্ণাঢ্য ও সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে। কিন্তু শুরুটা তো হতে পারে এই পদ্ধতির মাধ্যমে। তারপর পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাব্যবস্থা, ইন্টারনেট, তার সম্পর্কে প্রকাশিত বইপত্র, লাইব্রেরি এগুলো তো রইলই। কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর সলতেটা তো পাকিয়ে তোলা যেতে পারে এই নামকরণের মধ্য দিয়ে। এখানেই তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো নামকরণের ক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামকে প্রাধান্য দিলে তা ইতিহাস শিক্ষারও একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে বড় হওয়া প্রজন্মগুলোকে সঠিক ইতিহাসের ধারায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগটি অত্যন্ত কার্যকর। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে নানা রকম প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নামে শরশুনা বাজার সংলগ্ন চিত্রা নদীর ওপরে নতুন সেতুটির নামকরণ করা হলে এই উদ্যোগ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমি এই দাবি তুলে ধরলাম। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর এই উদ্যোগ হবে নিজেদেরই সম্মানিত করার প্রয়াস।
লেখক, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন পেশায় ছিলেন সাংবাদিক। স্বদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাতিকে রুখে দাঁড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা দিতে পত্রিকার পাতায় আর বক্তৃতার মঞ্চে প্রাণপণ সংগ্রাম-সাধনা করে গেছেন তিনি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে ধারা তৎকালীন সময়ে আমাদের সংগ্রামের পথ তৈরি করেছিল, দৈনিক ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে তিনি সেই ধারা সৃষ্টিকারীদেরই একজন। এ কারণেই তার কর্মমুখর জীবন কেবল জীবনীপাঠ্যই নয়, আমাদের ইতিহাসেরও একটি জরুরি অধ্যায়। ইতিহাসের এই বীর সাংবাদিক মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শরশুনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালে। নিজের মেধা আর প্রতিভার বলেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি স্বদেশের সংগ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। বহু বছর ধরেই লক্ষ্য করছি আমাদের শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকদের মধ্যে এমন একটি ধারণা জন্মেছে যে, দেশ নিয়ে ভাবার দায়িত্ব কেবল যারা রাজনীতি বা প্রশাসনে আছেন তাদেরই। অনেকেই সন্তানদের নিজেকে গড়ে নেওয়ার শিক্ষা দেন বটে কিন্তু নিজের অর্জনকে যে দেশের কল্যাণের কাজে লাগাতে হবে, সে শিক্ষাটি দিতে চান না। আমি নিজের একটি কাজের জন্য শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের মহৎ জীবনের অধ্যায়গুলোকে শিশুদের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। আর ঠিক এ জায়গাটিতেই আমার মনে হয়েছে, বর্তমান সময়ের সামাজিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে এমন মানুষদের জীবনীই নতুন প্রজন্মের কাছে বারবার তুলে আনা উচিত। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ শহীদ বুদ্ধিজীবী বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদদের সবার শৈশব-কৈশোর বা তারুণ্যই অতিবাহিত হয়েছে পরাধীনতার গ্লানি বহন করে। তাদের আত্মত্যাগের কারণেই সেই গ্লানি থেকে আজ আমরা মুক্ত। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জীবন থেকে হীরকখণ্ডগুলো তুলে আনা। তারই আলোকে আমাদের সামনের পথটুকু আলোকিত করে এগিয়ে চলা।
অনেকেই ভাবতে পারেন, মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শালিখা ইউনিয়নের শরশুনা বাজার সংলগ্ন চিত্রা নদীর ওপরে নতুন সেতুটির নাম শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নামে করলেই কি তার প্রতি আমাদের ঋণ শোধ হবে? না, হবে না। জীবনের বিনিময়ে তিনি যে আদর্শ আর সংগ্রামের পথ আমাদের দেখিয়ে গেছেন, সে ঋণ আমরা কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। কিন্তু তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সম্মানিত করতে পারব। তাছাড়া আরেকটি বিষয় আলোচনায় আনা খুব জরুরি। নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে কিশোর প্রজন্মের নানা নৈতিক স্খলনের বিষয়ে আজকাল আলোচনা উঠে এসেছে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের বক্তব্য ও লেখাতে দেখছি, তারা বলছেন- এই প্রজন্মের সামনে কোনো মহৎ প্রাণের দৃষ্টান্ত নেই। কথাটির সঙ্গে আমি সর্বাঙ্গে একমত নই। বরং বলা উচিত, আমরাই বর্তমান প্রজন্মের সামনে মহৎ প্রাণের মানুষদের তুলে ধরতে পারছি না। এ ব্যর্থতা আমাদের। যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সে গ্রামে জন্ম নেওয়া প্রতিটি প্রজন্মের কাছে তাকে তুলে ধরার সর্বোত্তম পন্থাটিই তো হতে পারে শরশুনা বাজার সংলগ্ন চিত্রা নদীর ওপরে নতুন সেতুটির 'শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন সেতু' নামকরণ। সেতুর ফলকে তার জীবনীভিত্তিক তথ্য থেকেই তো একজন কিশোর বা তরুণ তার বর্ণাঢ্য ও সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে জানতে পারবে। কিন্তু শুরুটা তো হতে পারে এই পদ্ধতির মাধ্যমে। তারপর পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাব্যবস্থা, ইন্টারনেট, তার সম্পর্কে প্রকাশিত বইপত্র, লাইব্রেরি এগুলো তো রইলই। কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর সলতেটা তো পাকিয়ে তোলা যেতে পারে এই নামকরণের মধ্য দিয়ে। এখানেই তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো নামকরণের ক্ষেত্রে শহীদ বুদ্ধিজীবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামকে প্রাধান্য দিলে তা ইতিহাস শিক্ষারও একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে বড় হওয়া প্রজন্মগুলোকে সঠিক ইতিহাসের ধারায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগটি অত্যন্ত কার্যকর। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে নানা রকম প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নামে শরশুনা বাজার সংলগ্ন চিত্রা নদীর ওপরে নতুন সেতুটির নামকরণ করা হলে এই উদ্যোগ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমি এই দাবি তুলে ধরলাম। সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর এই উদ্যোগ হবে নিজেদেরই সম্মানিত করার প্রয়াস।
লেখক, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
মন্তব্য করুন