করোনার সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বিস্তার এবং জনপরিসরে এ ব্যাপারে এখনও অসচেতনতা-অসতর্কতা কিংবা আক্রান্তের বিষয়ে গোপনীয়তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। 'গ্রামে গ্রামে উপসর্গ নিয়ে বসবাস' শিরোনামে বুধবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা যেন তৃতীয় ঢেউয়েরই বার্তাবহ। উদ্বেগপূর্ণ পূর্বাভাস একই সঙ্গে সতর্কতার ব্যাপক প্রচারের মধ্যেই দেশে ফের সংক্রমণের বিস্তার অনেকটাই মানুষের উদাসীনতা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে না চলার ভয়াবহ বিরূপ ফল- এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সংক্রমণ ও মৃত্যুহারের পরিসংখ্যান যেমন দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, তেমনি গ্রামে গ্রামে বাড়ছে করোনার উপসর্গ। শঙ্কার বাড়তি কারণ হলো, এর বেশিরভাগই থেকে যাচ্ছে প্রকাশের বাইরে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'মৌসুমি জ্বর-জারি' বলেও তা থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। এমন পরিস্থিতি শুধু যে এলাকাভিত্তিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে তা-ই নয়, একই সঙ্গে মারাত্মক বিস্ম্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমরা জানি, করোনা প্রাণঘাতী ভাইরাস হলেও তা প্রতিরোধ দুরূহ নয়। আমরা এও জানি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণই এ থেকে মুক্ত থাকার অন্যতম রক্ষাকবচ। গ্রামে নানা অজুহাতে পরীক্ষায় যেমন অনীহার বিষয়টি সমকালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তেমনি অজানা উৎস থেকে সংক্রমণ বিস্তারের গতি বাড়ার খবরও মিলেছে। এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পাশাপাশি সরকার দফায় দফায় বিধিনিষেধ বাড়িয়ে চললেও এর কার্যকারিতা কিংবা প্রয়োগ ব্যবস্থা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। সংক্রমণ রোধে প্রায় সারাদেশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করা হলেও ঢাকা থেকে নানাভাবে বহিরাগমন কিংবা ঢাকায় অনুপ্রবেশ থেমে নেই। আমরা দেখেছি, বিশ্বের অধিক আক্রান্ত দেশগুলোতে এলাকাভিত্তিক লকডাউন ও বিধিনিষেধ জারির সুফল কীভাবে মিলেছে। কিন্তু আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর পরিস্থিতি যখন ক্রমেই নাজুক হচ্ছিল, তখনও সংক্রমণ রোধে কাগুজে ব্যবস্থা যতটা নেওয়া হলো কার্যক্ষেত্রে অনেকাংশেই এর ব্যত্যয় ঘটল। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করায় সর্বাত্মক কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই। সংস্পর্শ-দূরত্ব বাড়ানোই শেষ কথা নয়, জানা-অজানা উৎস থেকে সংক্রমণের বিস্তারের পথ রুদ্ধ করতেই হবে। 'বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো'র মতো লকডাউন বা বিধিনিষেধ জারি করে এখন আর বসে থাকার অবকাশ নেই। আমরা মনে করি, জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করেই এ রকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। করোনা আক্রান্ত বিশ্বে এর নজির আছে। স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণে যেমন বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া যাবে না, তেমনি চিকিৎসাসেবার পরিসর বাড়ানোর দিকেও দ্রুত নজর দিতে হবে। আমরা বিদ্যমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধিক সংক্রমিত এলাকায় ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার তাগিদও সমগুরুত্ব দিই। ফিল্ড হাসপাতালের মাধ্যমে যেমন নিম্নবিত্ত শ্রেণির শনাক্তদেরও চিকিৎসা দেওয়া অনেকটাই সহজ হবে, তেমনি আইসোলেশন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা যাবে। উচ্চ সংক্রমিত প্রত্যেক এলাকায় বিশেষ করে গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। করোনা পরীক্ষা সহজ না করলে অনেকেই উপসর্গ নিয়ে বসবাস করবে- এটাই স্বাভাবিক। গ্রাম পর্যায়ে যেভাবে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে সেখানে পরীক্ষা ও চিকিৎসার পরিসর বাড়াতেই হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলদের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিবিড় করে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। ব্যক্তি নিজে সুরক্ষিত না থাকলে পরিবার-সমাজের সুরক্ষা দুরূহ। আমরা জানি, সংক্রমণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পথ রুদ্ধ করা মোটেও কঠিন কিছু নয়- যদি এ বিষয়ে মানুষকে যথেষ্ট মাত্রায় সচেতন ও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় বাধ্য করা যায়। ব্যক্তি, পরিবার, পাড়া-মহল্লা, শহর কিংবা গ্রামের সবার যূথবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। আশার কথা, জনসনের সাত কোটি ডোজ টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। এই সিদ্ধান্ত ত্বরিত নেওয়ার পাশাপাশি টিকার আরও উৎস সন্ধানে জোরদার তৎপরতার তাগিদও আমরা ফের দিই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আমাদেরও টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়া গতিশীল করা জরুরি। সমগ্র জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতেই হবে এবং তা যত দ্রুত সম্ভব ততই মঙ্গল।