এক সময় দেশের বৃহৎ নৌবন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চিলমারী বন্দর। ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দরের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এই বন্দর সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে সেই ব্রিটিশ আমলে বড় বড় পণ্যবোঝাই জাহাজ চলাচল করত। ভারতের কোচবিহার, আসাম, মেঘালয়; চীন ও মিয়ানমার থেকে এসব জাহাজ পণ্য বোঝাই করে চলাচল করার সময় চিলমারী নৌবন্দরে নোঙর করত। বিদেশি জাহাজ চলাচল করায় এখানে স্থাপিত হয়েছিল কাস্টম অফিস। পাশাপাশি চিলমারী নৌবন্দরটি ছিল পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। সে সময় পাটই ছিল রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত। শুধু চিলমারী বন্দরই যে পাটের একমাত্র ব্যবসাকেন্দ্র ছিল, তা নয়। কুড়িগ্রাম জেলা তো বটেই, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পাটও চিলমারী নৌবন্দরে বোঝাই হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেত। আর গরুর গাড়িই ছিল পণ্য পরিবহনের একমাত্র বাহন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার গরুর গাড়িতে পাট বোঝাই করে আনা হতো চিলমারী নৌবন্দরে। তারপর তোলা হতো বড় বড় পানসি নৌকায়। এর পর সেসব পাট যেত পাটের রাজধানীখ্যাত নারায়ণগঞ্জ, দৌলতপুর, খুলনা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। আর সড়কপথে গরুর গাড়ি চলত কাঁচা রাস্তায়। এখনকার মতো পাকা রাস্তা তো শহরেই ছিল না। আর গ্রামে থাকার প্রশ্নই আসে না। একমাত্র পাট ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে চিলমারী বন্দরের পরিচিতি ছিল দেশ-বিদেশে। আজ সেসব শুধুই স্মৃতি!
১৯৬৭ সালের দিকে চিলমারী বন্দর এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাসে চিলমারী বন্দরটি বিলীন হয়ে যায়। দুর্ভাগ্য- স্বাধীন দেশে নিশ্চিহ্ন চিলমারী বন্দরটি পুনঃস্থাপনে ঐকমত্যের অভাবে তা তিন স্থানে স্থাপিত হয়। অবশ্য তিন স্থানের তিনটি আলাদা বৈশিষ্ট্যও ছিল, যা অনেকটাই কাকতালীয়। যেমন- থানাহাট ইউনিয়নের থানাহাট বাজারে স্থাপিত হয় চিলমারী থানার প্রশাসনিক কাজের সরকারি অফিসগুলো। রমনা নামক স্থানে স্থাপিত হয় পাটের গুদাম। আর জোড়গাছ নামক স্থানে পণ্য বেচাকেনার জন্য স্থাপিত হয় একটি বড় বাজার।
সে মুহূর্তেও দেখেছি পাটচাষিদের পাট চাষের আগ্রহ ও পাট ব্যবসার কর্মচঞ্চলতা। কিন্তু ন্যায্যমূল্যের অভাবে পাট হয়ে গেল কৃষকের গলার ফাঁস। আর একে একে নিঃশেষ হতে থাকল পাটের রমরমা ব্যবসার চিরচেনা ঐতিহ্য। পাট ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় পাটগুদামকে ঘিরে গড়ে ওঠা রমনা বাজার পরিণত হলো ভূতুড়ে বাজারে! ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট ব্যবসায় জড়িত হাজার হাজার ফড়িয়া, পাইকার, গরুর গাড়ির চালক থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ী পর্যন্ত রুটি-রুজি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন। যে কারণে চিলমারীর মানুষের অভাব-অনটন আর দারিদ্র্য চরম আকার ধারণ করে। পাটশিল্প ও পাট ব্যবসা ধ্বংস হওয়ায় স্বভাবতই চিলমারী বন্দরটিও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
অবশ্য ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দরটির হারানো যৌবন ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর চিলমারী নৌবন্দর স্থাপনের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান একটি পন্টুন স্থাপন করে চিলমারী নৌবন্দরের উদ্বোধন করেন। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের অভাবে গত পাঁচ বছরে নৌবন্দরের কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। করোনাকালীন এই মহাদুর্যোগের মধ্যে গত ৮ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে চিলমারী নৌবন্দরকে নতুন সাজে সাজাতে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। বাস্তবেই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অতি দরিদ্রতম উপজেলা হিসেবে পরিচিত চিলমারীর কর্মজীবী মানুষের কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতিতে এক অমিত সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে চিলমারীর সর্বস্তরের মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছে। আমরা মনে করি, চিলমারী বন্দরটি আধুনিকায়ন করলে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
সাবেক ছাত্রনেতা
মন্তব্য করুন