লকডাউন ঘিরে আমের দাম না পাওয়ার যে হতাশা চাষিদের মধ্যে বিরাজ করছে, তার বাস্তবতা উপেক্ষা করার উপায় নেই। রোববার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদনে এসেছে, চাষিরা অভিযোগ করেছেন- লকডাউনের ঘোষণা আসার পরই আড়তদাররা আম পাঠাতে নিষেধ করছেন। তাদের যুক্তি, মানুষ বাইরে বের হতে না পারলে আম কিনবে কীভাবে? তাদের যুক্তি অংশত সত্য হলেও বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের বিকল্প নেই। যদিও প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, আম ব্যবসার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবই লকডাউনের বাইরে। বলা বাহুল্য, ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় এ মাসের শুরু থেকেই লকডাউন চলছে। সে হিসেবে আমপ্রধান এলাকা রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের চাষিদের অনেকে এরই মধ্যে তার প্রভাবে পড়েছেন। তবে আঞ্চলিক লকডাউন হওয়ায় তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হননি বলে সেখানকার চাষিরা গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, আম্রপালি আমের দাম মোটামুটি ভালো পেয়েছেন।

সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্মণভোগ, ফজলি, গুটিসহ অন্যান্য প্রজাতির আমের দাম পাচ্ছেন না এবং এর মধ্যেই সারাদেশে কঠোর লকডাউনের খবরে আমচাষিরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় পড়েছেন। আমরা দেখেছি, বাজারে পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ায় সাতক্ষীরার আম ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকরাও লোকসানের মুখে পড়েছেন। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আমের দাম নিম্নমুখী সেখানে। গত বছর করোনার কারণে সেখানকার চাষিরা যেমন বিদেশে আম পাঠাতে পারেননি, তেমনি ঘূর্ণিঝড় আম্পানে অনেক চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সৌভাগ্য বলতে হবে, অন্যান্য বছর ঝড় ও শিলাবৃষ্টি আমের বিপদের কারণ হলেও এবার কৃষকরা তা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। এমনকি রাজশাহীরও সব আমচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা নয়। যেসব জাতের আম দেরিতে পাকে, সেই চাষিরাই ক্ষতির শঙ্কায় রয়েছেন। আমরা মনে করি, এ ক্ষতি পূরণ করাও অসম্ভব হবে না।

প্রথমত, সরকার এরই মধ্যে আম পরিবহন লকডাউনের বাইরে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, আড়তদার কিংবা আম ব্যাপারিদের বোঝা উচিত, লকডাউন হলেও মানুষের খাওয়া বন্ধ হবে না। লকডাউনে কাজের প্রয়োজনে কেউ বের হতে না পারলেও বাজার বন্ধ হবে না। আম পরিবহন আর বাজার খোলা থাকলে তার ওপর লকডাউনের প্রভাব কীভাবে পড়বে? তৃতীয়ত, এখন অনলাইনে অনেকেই আম বেচাকেনা করে থাকেন। অনলাইন উদ্যোক্তারা সরাসরি কৃষকদের থেকে আম ক্রয় করলে কৃষক লাভবান হবেন। এবার আমের রাজধানীখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বাধিক আমের উৎপাদন হলেও সেখানকার ফজলি ও আশ্বিনা জাতের আম দেরিতে আশায় শঙ্কায় রয়েছেন কৃষক। আমরা জানি, সেখানকার অধিকাংশ আমচাষি এ ফলটির ওপর নির্ভরশীল। তারা সারাবছর এর পেছনে সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেন। আমের এ মৌসুমে তারা বিনিয়োগের ফল প্রত্যাশা করেন। এ মৌসুমে আম পাকলে গাছ থেকে পাড়া ও বাজারজাত করতেও খরচের ব্যাপার রয়েছে। সব মিলিয়ে কাঙ্ক্ষিত দামে আম বিক্রি করতে না পারলে অনেকে লাভের মুখ দেখবেন না।

এমনকি হয়তো খরচ তোলাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। আমরা দেখছি, প্রায় প্রতি বছর আমচাষিরা কোনো না কোনো কারণে এভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন। অবস্থা অনুযায়ী পদক্ষেপের পাশপাশি দীর্ঘমেয়াদে চাষির লোকসান কমাতে আম প্রক্রিয়াজাতকরণের বিকল্প নেই। আমের বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া উন্নতকরণ এবং সরকারিভাবে জেলায় জেলায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে অল্প সময়ের মধ্যে বিক্রির বাধ্যবাধ্যকতা থাকবে না। প্রযুক্তির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কাঁচা আম ৬ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। কাঁচা ও পাকা উভয় ধরনের আম দিয়ে আমসত্ত্ব, আমচুর, ম্যাংগো বার, আমের জুস, আমের আচার, চাটনি, জ্যাম, জেলিসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা যায়। দেশে কয়েকটি কোম্পানি আমের এসব খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত করে থাকে, যা চাহিদা অনুযায়ী নগণ্য। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এভাবে আরও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে আম উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষক, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান সবাই লাভবান হতে পারেন।