লিপি আক্তার একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। গ্রামে বড় হওয়া লিপি বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন। ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষা শেষ করে দেশের কাজে নিয়জিত হবেন এবং কাজ করবেন প্রতিবন্ধী উন্নয়নের লক্ষ্যে। তবে স্বপ্টম্ন বাস্তব রূপ নেওয়ার আগেই করোনার ভয়াল থাবা কেড়ে নিল তার মূল্যবান জীবন। লিপি আক্তারের বড় বোন বলেন, করোনার টিকা নিয়ে অনেকে গুজব ছড়ায়, যার কারণে মানুষের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। আমার বোনের মতো মানুষের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে। আমার বোন কীভাবে করোনায় আক্রান্ত হলো তা বুঝে ওঠার আগে সে আমাদের রেখে চলে গেল। গুলশান আরা একজন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধীর মা বলছিলেন, কিছুদিন আগে আমার করোনা ধরা পড়ে। আমি আমার ছেলেকে কিছুতেই আলাদা রাখতে পারিনি। আমার ছেলের বয়স ২৫; প্রতি মাসে তাকে থেরাপি নিতে হয়। প্রতিবন্ধী কেউ আক্রান্ত হলে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা খুব কষ্টকর, কারণ শ্বাসকষ্ট বাড়লে আইসিইউতে একা রাখা যাবে না বা থাকবে না। সেই জন্য প্রতিবন্ধী এবং বিশেষ করে মাকে টিকা দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
করোনায় যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভয়ংকর পরিস্থিতি, বাংলাদেশ কিছুটা হলেও সামলে নিয়েছিল। প্রথম ঢেউ থেকে কিছুদিনের জন্য স্বস্তি মিললেও জেঁকে বসেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রতিদিন দেশে করোনাভাইরাসে শনাক্তের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১৫% প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধীরা বৈশ্বিকভাবে অপ্রতিবন্ধীদের থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও পিছিয়ে থাকে। করোনার ছোঁয়াচে থাবায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কতজন প্রতিবন্ধী আক্রান্ত হয়েছেন বা মৃত্যু হয়েছে, তা জানা যায়নি। বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের জন্য অগ্রাধিকার তালিকায় আসেনি প্রতিবন্ধীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপর কভিড ১৯ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে সহজে টিকার সাইটে ঢুকতে পারে, টিকা গ্রহণ করতে পারে এবং নারীরা যাতে টিকা গ্রহণের সময় বৈষম্যের শিকার না হয় সেদিকে লক্ষ্য দিতে হবে।'
ব্রীজ ফাউন্ডেশন করোনাকালে বিভিন্ন জেলার তরুণ প্রতিবন্ধী প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে; সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরেন তরুণ প্রতিনিধিরা। ১. প্রতিবন্ধীদের করোনা টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। ২. প্রতিবন্ধীদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন, তাদের কোনো সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমাদের এই তথ্যগুলো জানা দরকার। ৩. করোনায় আক্রান্ত হলে শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীদের তথ্যসেবার অপ্রতুলতা রয়েছে। ৪. প্রতিবন্ধীদের টিকা গ্রহণ কেন্দ্রে আলাদা লাইনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৫. প্রতিবন্ধীদের কাজের সঙ্গে যারা নিয়োজিত তাদের টিকার আওতায় আনতে হবে। ৬. প্রতিবন্ধী ও গুরুতর প্রতিবন্ধী রোগীর চিকিৎসার জন্য কিছু টেকনিক্যাল বিষয় থাকে, যার জন্য হাসপাতালগুলোতে সেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। ৭. করোনায় আক্রান্ত প্রতিবন্ধীদের জন্য হাসপাতালগুলোতে আলাদাভাবে সেবা চালু করতে হবে।
অনেক প্রতিবন্ধী আছেন যাদের স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে নিয়মমাফিক থেরাপি নিতে হয়। কিন্তু করোনার ভয়াবহতার কারণে প্রতিবন্ধীরা এই সেবা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান) সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সম্মুখীন হচ্ছে করোনাকালে। প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য হোম সার্ভিস করোনা টেস্ট এবং টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের কথা বিবেচনা করে সঠিক তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবন্ধীবান্ধব তথ্য প্রচার করা খুব দরকার। ব্রীজ ফাউন্ডেশনের করা এক জরিপে দেখা যায়, ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ কাজ হারিয়েছেন করোনাকালে। জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের ১০৩টি সেবাকেন্দ্র রয়েছে প্রতিবন্ধীদের সেবা প্রদানের জন্য, সেখানে তালিকার ভিত্তিতে যদি টিকাগ্রহণ, রেজিস্ট্রেশন ও টিকা দেওয়া হয় তাহলে প্রতিবন্ধী মানুষের ভোগান্তি অনেক কমে আসবে। সচেতন ও প্রতিবন্ধী মানুষের দাবি, প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকাদানে সুযোগ দিতে হবে।
সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রীজ ফাউন্ডেশন
swarnamoyeesarker@gmail.com