একটি পণ্য পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, পণ্য আমদানিকারকরা সেটি সস্তায় আমদানি করতে চান। কোনো কোনো সময় তারা পণ্যটি প্রস্তুতকারক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা তাদের প্রতিনিধির কাছ থেকে সংগ্রহ করেন; আবার কোনো কোনো সময় তৃতীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। প্রস্তুতকারক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের উদ্ভাবিত পণ্যের জন্য পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিআই, কপিরাইটসহ বিভিন্ন ধরনের মেধাস্বত্ব দাবি করতে পারেন এবং সেগুলোকে যথাযথ মেধাসম্পদ কর্তৃপক্ষের নিকট নিবন্ধন করিয়ে নেন। ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজে পণ্যটি একটি দেশে বাজারজাত করতে পারেন এবং সেটি আবার ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিনা অনুমতিতে তৃতীয় কোনো মাধ্যমে অন্য দেশে আমদানি হতে পারে। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই উদ্ভাবনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় লাইসেন্স চুক্তির মাধ্যমে পণ্যটির উৎপাদন এবং সরবরাহের অধিকার লাভ করতে পারেন। এ চুক্তিতে উদ্ভাবনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সদাতা হিসেবে লাইসেন্স গ্রহীতার কাছ থেকে কী পরিমাণ লাইসেন্সিং ফি বাবদ রয়্যালিটি পাবেন, কী উদ্দেশ্যে- যেমন উৎপাদন সুবিধার অভাবে অন্যকে উৎপাদনের অধিকার প্রদান, পর্যাপ্ত উৎপাদন না করতে পারার কারণে অন্যকে উৎপাদনের অধিকার প্রদান বা একটি ভৌগোলিক বাজারে মনোনিবেশ করা, কত সময়ের জন্য চুক্তিটি বলবৎ থাকবে, উৎপাদিত পণ্যটি কোন নির্ধারিত অঞ্চলে সরবরাহ করা হবে বা এটি অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করা যাবে কিনা ইত্যাদি শর্তের উল্লেখ থাকে। এরূপ সম্মতি লাভকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পণ্যটি কোনো একটি দেশে বাজারজাত করলে তার অগোচরে অন্য কারও মাধ্যমে সেটি অন্য দেশে আমদানি হতে পারে।
উদ্ভাবনকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা তার সম্মতিতে লাইসেন্স গ্রহীতা একই পণ্য একই সঙ্গে তৈরি ও বাজারজাত করতে পারেন। এরপর আমদানিকারক পণ্যটি উদ্ভাবনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাজারজাতকৃত দেশ থেকে বা লাইসেন্স গ্রহীতার লাইসেন্স চুক্তিতে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার অবর্তমানে তার দেশ থেকে আমদানি করতে পারেন। তবে উভয় দেশের মধ্যে সস্তা রপ্তানিকারক দেশকেই আমদানিকারক হয়তো প্রাধান্য দেবেন এবং আরও দেখবেন যেন পণ্যটি বৈধভাবে তৈরি এবং সেটি নকল বা পাইরেটেড নয়। এরূপ সস্তা রপ্তানিকারক দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল মেধাস্বত্বাধিকারীর অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না।
ধরা যাক, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি তাদের তৈরি কভিড-১৯ ভ্যাকসিনটি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫০০ টাকায় বাজারজাত করছে। এরপর দেখা গেল, ইন্ডিয়ার সেরাম ইনস্টিটিউট সেটির যথাযথ লাইসেন্স নিয়ে এসে সস্তাশ্রমে ইন্ডিয়াতে ভ্যাকসিনটি তৈরি করে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০০ টাকায় সেখানে বাজারজাত করছে। আর বাংলাদেশে এটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতিনিধির মাধ্যমে ২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের কোনো ওষুধ কোম্পানি যদি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি বা সেরাম ইনস্টিটিউটের অগোচরে যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, ইন্ডিয়া বা অন্য কোনো বাজার থেকে ভ্যাকসিনটি আমদানি করে তবে এই আমদানি সমান্তরাল আমদানি বলা যাবে। এ সমান্তরাল আমদানি কি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ? শিল্প সম্পদের মেধাস্বত্ব সম্পর্কিত ১৮৮৩ সালের প্যারিস কনভেনশন সমান্তরাল আমদানির বিষয়ে নীরব। এরপর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯৪ সালের ট্রিপস অ্যাগ্রিমেন্টের ক্ষেত্রে আশা করা হয়েছিল, এটি সমান্তরাল আমদানিসহ মেধাসম্পদের সবদিক নিয়ে কথা বলবে। প্রকৃতপক্ষে সমান্তরাল আমদানি যে আরেকটি বাণিজ্য চুক্তি গ্যাট কর্তৃক অনুমোদিত আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যকে সমুন্নত করে, ট্রিপস চুক্তিটি তা স্বীকার করলেও সমান্তরাল আমদানির জন্য সাধারণ অনুমতি দিতে সম্মত হতে পারেনি। এই অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে চুক্তিটির ৬ অনুচ্ছেদ ঘোষণা করেছে যে, এই চুক্তির অধীনে বিবাদ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এই চুক্তির কোনো কিছুই মেধাস্বত্বের নিঃশেষণ-সংক্রান্ত বিচার্য বিষয়ে ব্যবহূত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে সমান্তরাল আমদানি অবৈধ নয়। এসব দেশের ডলার শপ, পাউন্ড শপ বা রিজেক্ট শপে প্রাপ্ত পণ্যগুলো সমান্তরালভাবে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানিকৃত এবং এগুলো যথেষ্ট সস্তা। এর কারণ হতে পারে সেগুলো নিম্নমানের কাঁচামাল ও সস্তা শ্রমে তৈরি অথবা স্বত্বাধিকারী বিভিন্ন বাজারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পণ্য উৎপাদন করেছেন এবং সেগুলোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন মূল্য নির্ধারণ করেছেন বা উৎস দেশের আইনি কাঠামো কম খরচে পণ্যগুলো উৎপাদনে সহায়তা করেছে ইত্যাদি। তবে এই সমান্তরাল আমদানিকৃত সস্তা পণ্যগুলোর প্রতি ভোক্তারা বেশি আকৃষ্ট হন। আবার এরূপ আমদানি স্থানীয় বাজারের মধ্যে দামের বৈষম্য রোধ এবং প্রবল প্রতিযোগিতা তৈরিতে সহায়তা করে।
এসব দেশের আইনি কাঠামো কীভাবে সমান্তরাল আমদানিকে বৈধতা দেয়? সমান্তরাল আমদানিকে বৈধতা দিতে দেশগুলো নানাবিধ রীতিনীতি অনুসরণ করে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে- নিঃশেষণের নীতি যা স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিঃশেষণ নামে পরিচিত। এই ধারণা অনুসারে পণ্যটি যখন কোনো নির্দিষ্ট দেশের বাজারে প্রথমে আসে, তখন স্বত্বাধিকারী সুরক্ষিত পণ্যের পুনঃবিক্রয় নিয়ন্ত্রণের অধিকার হারান। প্রকৃতপক্ষে তার অধিকারগুলো নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং সে দেশের সব বাসিন্দা সমান্তরাল আমদানির অনুমোদন লাভ করে। এ অবস্থায় সে দেশের যে কোনো বাসিন্দা আমদানিকারক হিসেবে যে কোনো বৈধ উৎস থেকে পণ্যটি আমদানি করে কম মূল্যে বিক্রি করলে স্বত্বাধিকারী তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না।
ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে সহায়ক হলেও সমান্তরাল আমদানির এ বিধানটি বাংলাদেশের কোনো আইনে লিপিবদ্ধ নেই। এর কারণ হতে পারে, বাংলাদেশের মেধাস্বত্ব আইনগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ১৯১১ সালের পেটেন্টস ও ডিজাইনস আইন অধুনা সম্পাদিত ট্রিপস অ্যাগ্রিমেন্টকে অনুসরণ করে না। ২০২১ সালের ড্রাফট পেটেন্ট আইনে আন্তর্জাতিক নিঃশেষণের কথা বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে কোনো একটি পেটেন্ট পণ্য বিশ্বের যে কোনো বাজারে প্রথমে এলে বাংলাদেশের যে কেউই পেটেন্ট মালিকের বিনা অনুমোদনে সেটি আমদানি করতে পারবেন। তবে ২০১৯ সালের মেধাস্বত্ব বলবৎকরণ (আমদানি ও রপ্তানি) বিধিমালা অনুসারে আমদানিকারককে কাস্টমস বন্দরে পণ্যটি যে বৈধভাবে তৈরি এবং সেটি নকল বা পাইরেটেড নয়- এ মর্মে যথাযথ দলিলাদি প্রদর্শন করতে হতে পারে। এরূপ বিধান অন্যান্য মেধাস্বত্ব আইনেও সংযুক্ত এবং কার্যকর করা গেলে কভিড-১৯ ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য মেধাসম্পদ পণ্য এ দেশে সহজলভ্য করা যাবে।
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়