- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- রাষ্ট্র বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে না
সমকালীন প্রসঙ্গ
রাষ্ট্র বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে না

নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জোসেফ স্টিলিজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি কিছু মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বৈষম্য সমাজের বড় শত্রু। অধ্যাপক স্টিলিজের মন্তব্য সর্বজনীন। চলতি অর্থবছরে আমাদের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বাজেট শতভাগ ব্যবসায়িক। কোনো দেশের জাতীয় বাজেট কি এরূপ হতে পারে?
আমরা প্রতিবারই শুনি এবার ব্যবসাবান্ধব, বিনিয়োগবান্ধব বাজেট হবে ইত্যাদি। কিন্তু সার্বিকভাবে বাজেটের ক্ষেত্রে উচ্চারিত হওয়া উচিত জনবান্ধব শব্দটি এবং এর বাস্তবায়নের ওপরই দেশ-জাতির কল্যাণ নির্ভর করে। রাষ্ট্র জনগণকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেবে; কোনো গোষ্ঠী বা মহলকে নয়। আমাদের সমাজে এমনিতেই বৈষম্যের দাগ অনেক মোটা। এর মধ্যে যদি রাষ্ট্রীয় কার্যকরণের ফলে এই দাগ আরও মোটা হওয়ার রাস্তা তৈরি হয়, তাহলে তা শুধু পরিতাপেরই নয়; অকল্যাণের পথও চওড়া করে। স্বাধীন বাংলাদেশে বৈষম্যহীন সমাজ বিকশিত হবে- একাত্তর পর্বে এ ছিল আমাদের অন্যতম অঙ্গীকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরেও আমরা এ থেকে অনেক দূরে। উচ্চারণ-অঙ্গীকারে এ ব্যাপারে কোনো ঘাটতি না থাকলেও বিদ্যমান বাস্তবতা এর বিপরীত।
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যর অগ্রগতির জন্য যেসব রাষ্ট্রীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন, তা তো রাষ্ট্রকে দিতেই হবে। শুধু ব্যবসা কেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং পরিষেবার জন্য যা করা দরকার, তাও রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এ কারণে সরকারের তরফে অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন- পথঘাটের উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, জনস্বার্থ-সংশ্নিষ্ট এসবের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব তো আরও অনেক বেশি। নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব। বাজেট প্রণয়নের আগে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়। সরকার বিদেশ থেকে সাহায্য পেয়ে থাকে, দেশেও ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজস্ব ব্যয়ের জন্য জনগণ কর দেয়। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার তার ভাষণে বলেছিলেন, যারা উচ্চশিক্ষা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন, তাদের লেখাপড়ার খরচও বাংলার কৃষক-শ্রমিকরা দেন।
যখন কোনো দুর্যোগ বা মহামারি অথবা সংকট দেখা দেয়, তখন রাষ্ট্রের কর্তব্য সবার কল্যাণে এগিয়ে আসা। বিশ্বের ধনী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে যখন করোনা মহামারি শুরু হলো, তখন সেখানে লকডাউন দেওয়া হয় এবং সেখানকার ফেডারেল সরকার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক সাহায্য বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। বেকার, সর্বনিম্ন আয়ের ব্যক্তি, আরও যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন- আনুপাতিক হারে ফেডারেল সরকার তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছে; তা নিশ্চয়ই ফেডারেল বাজেট থেকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে যখন দুর্যোগ দুর্বিপাক দেখা দেয়, তখন পুরো দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায় এবং আলোচনা-সমালোচনার তীরও সরকারের দিকেই ছোটে। অন্যরা এগিয়ে আসেন, তবে সেটা অপশনাল। কম্পলসারি দায়িত্ব সরকারের। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতি তাদের অনেকেই ফটোসেশনের মাধ্যমে সরকারের তহবিলে অর্থ দেন। তার জন্য আবার তাদের করও মওকুফ করা হয়ে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ভূমিহীন, গৃহহীনদের ভূমি ও গৃহদান। তার প্রত্যাশা- মুজিববর্ষে বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হলে তা হবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিত্তশালীরা রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গৃহনির্মাণ করেই ক্ষান্ত হন না। ঢাকার অদূরে বিরাট এলাকাজুড়ে বাগানবাড়ি নির্মাণ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের সমাজে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, এমন মানুষ এখনও অনেক। করোনা দুর্যোগ দারিদ্র্যের হার ফের বাড়িয়েছে, যেখান থেকে আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছিলাম।
বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য কর কমানোর দাবি ওঠে। ইতোমধ্যে করপোরেট করের হার বেশ কমানো হয়েছে। ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রের উদাহরণ দেওয়া হয়ে থাকে। সেখানে করপোরেট করের হার কমিয়ে শতকরা ১৫ থেকে ২০-এ আনা হয়। আমরা বলতে চাই না যে, সামাজিক নিরাপত্তা কর আদায় করা হয়, যার হার শতকরা ১৫ থেকে ২০। এ ক্ষেত্রে স্পষ্টতই দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি জড়িত। আমাদের সমাজে বুড়োদের সম্মান দিয়ে বলা হয় জ্যেষ্ঠ নাগরিক। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে তাদের কতটুকু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে? আমি একবার লন্ডন শহর থেকে অনেক দূরে ছোট শহরে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম। ওষুধ বিক্রেতা নিজ থেকে জিজ্ঞাসা করলেন- কোনো সোশ্যাল বেনিফিট কার্ড আছে কিনা।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আমাদের দেশে বেশ কিছু কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। যেমন বয়স্ক ভাতা, দুস্থ মহিলা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশুর মায়ের ভাতা ইত্যাদি। কিন্তু এই ভাতা পর্যাপ্ত কিনা সংখ্যায় ও পরিমাণে তা আমাদের বাজেটে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ছিল বিশদভাবে। এক পাতা ওষুধের দাম কমপক্ষে ১০০ টাকা। সমাজের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের চিকিৎসার জন্য আলাদা বেনিফিট দেওয়া যায় কিনা তা দেখা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতে শতকরা ৫০ ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তা কি আদৌও নূ্যনতম প্রয়োজন মেটাতে পেরেছে? বরাদ্দের বড় অংশের অপচয়, লুটপাট হয়। করোনা দুর্যোগ তা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের পরিধি বাড়ানো অবশ্যই প্রয়োজন। এবারের বাজেটে একটা বড় চাপ রয়েছে করোনা মহামারির। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, করোনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে মহামারির যে প্রকোপ এবং এক, দুই, তিন করে একের পর এক ঢেউ যেভাবে স্ম্ফীত হচ্ছে তাতে এই বরাদ্দে চলবে কিনা তা বলা কঠিন। চলমান দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের তরফে সাহায্য-সহায়তার পরিসর ক্রমেই বাড়াতে হবে। তাতে অবশ্য বাজেটের অভ্যন্তরীণ খাতের পুনর্বিন্যাস করতে হতে পারে। বাজেটে কিছু ুখাত রয়েছে, যেগুলো সময়মতো বরাদ্দ করা অর্থ ব্যয় করতে পারে না।
শুরুতে বলেছিলাম, রাষ্ট্রের বাজেট গোষ্ঠীবিশেষের হতে পারে না। ৩০ লাখ শহীদ ও কয়েক লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বাঙালিকে ধ্বংসস্তূপে নিপতিত করেছিল পাকিস্তানিরা। স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে শতভাগ মানসিক প্রস্তুতি এনে দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগে বাঙালি স্বাধীন ছিল না। ছিল সেনাশাসন বা নবাবের শাসন। মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করেনি। আর সেজন্য বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু জনসমুদ্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বলেছিলেন, 'বাঙালিরা আজ মানুষ হয়েছে, তারা আজ স্বাধীন।' তাই মনে করি, আমাদের বাজেটে থাকবে সবার কথা। রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্য সৃষ্টির কোনো অবকাশ নেই। প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার সমান। রাষ্ট্র যদি বৈষম্য জিইয়ে রাখার কারণ হয়, তাহলে এর বিরূপ প্রভাব বহুমুখী হতে বাধ্য। কোনো গোষ্ঠী বা মহলের লাভালাভ হিসাব করে রাষ্ট্রীয় বাজেট হবে কেন? রাষ্ট্রীয় বাজেট প্রণীত হবে গোটা জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা মাথায় রেখে।
মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা; শেয়ারবাজার, বীমা ও ব্যাংক খাত বিশ্নেষক
মন্তব্য করুন