করোনা মহামারির প্রভাবে দেশে যে বিপুল সংখ্যক নতুন দরিদ্র তৈরি হয়েছে, তা পিপিআরসি-বিআইজিডিসহ অন্যান্য গবেষণায়, এমনকি আঞ্চলিক ও বিশ্বের অন্যান্য জায়গার গবেষণায়ও উঠে এসেছে। তবে যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য তা হলো, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যেখানে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৫৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ছিল ৪৪ শতাংশ। এই নতুন দরিদ্র শ্রেণি সাধারণত দারিদ্র্যসীমার ওপরেই বসবাস করে, কিন্তু যে কোনো অভিঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। তাদের মধ্যে অনেকে অর্থনৈতিক সংকট কেটে গেলে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু করোনা অতিমারির সময়কালে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বড় অংশের জন্য থমকে আছে। আগামী অথনৈতিক অনিশ্চয়তা ইঙ্গিত করছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যাওয়া এ বিশাল জনগোষ্ঠী আপাতত দারিদ্র্যের মধ্যেই আটকে আছে। আয়-উপার্জন কমে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র মানুষের কাতারে চলে আসার এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলসহ গোটা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের জন্য এই সমস্যার সমাধান বড় একটি চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের জন্যও এটি ছোট বিষয় নয়। বিশেষ করে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশের জীবনমানে হঠাৎ অবনমন স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা যায় না। এ অবস্থায় নতুন দরিদ্রদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু যে বিষয়টি আমরা দেখছি সেটি হলো গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য যতটা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, শহরের দরিদ্র মানুষের জন্য ততটা করা হচ্ছে না। আমরা জানি, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের সমস্যা বহুবিধ। বিশেষ করে চারটি বড় সমস্যার কথা বলাই যায়। এর মধ্যে প্রথমটি হলো- করোনার প্রভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশায় চরম অনিশ্চয়তা। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের মোট শ্রমশক্তির বিপুল অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। শহরেও তাদের সংখ্যাই বেশি। নির্মাণ খাত, পরিবহন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, হোটেল-রেস্তোরাঁয় সংশ্নিষ্টরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। আমরা দেখেছি, শহরে অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশায় নিয়োজিতদের আয় কমেছে ১৪ শতাংশ। তাদের আবার ৮ শতাংশ এখনও বেকার। অনেকেই আবার টিকে আছেন কর্মবদল করে। এ সময়ের মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অপেক্ষাকৃত কম দক্ষতার পেশায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের দ্বিতীয় সমস্যা হলো- তাদের খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। শহরে যেহেতু তাদের নিজস্ব থাকার ব্যবস্থা নেই, তাই বাসা ভাড়া করে থাকার খরচ বেড়েছে। বেড়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবহন এবং গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের মতো ইউটিলিটি খরচও। চলতি বছরের মার্চ মাসে এ খাতে ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৯৮ শতাংশ। তৃতীয় সমস্যা হচ্ছে- নিম্ন আয়ের মানুষের আর্থিকভাবে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা কমে গেছে। তাই শহর এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। এক বছর আগে তাদের ঋণ নেওয়ার হার ছিল বার্ষিক আয়ের ১৩ শতাংশের মতো। এটি দ্বিগুণ হয়ে এখন ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়।
চতুর্থ এবং বড় সমস্যা হলো নতুন দরিদ্রদের বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যথাযথ মনোযোগ না দেওয়া। এর ফলে তারা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসছে না এবং সেভাবে সাহায্য পাচ্ছে না। তবে শহরে বিশেষ করে বয়স্ক ভাতা অনেকেই পাচ্ছেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাবে যদি বলা হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে শহরের বয়স্ক ভাতার হার ৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছে ২৬ শতাংশ। বিধবা ভাতা শহরে নেই বললেই চলে, মাত্র ০.০৫ শতাংশ। ভাতার দিক থেকেও শহরের দরিদ্র মানুষ কীভাবে বঞ্চিত তা বোঝা যায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে গ্রামে সহায়তার যতটা খাত রয়েছে, শহরে তা নেই। গত বছরের হিসাবে দেখা গেছে, শহরের মানুষ পাচ্ছে জিআর তথা সাধারণ সহায়তা, ভিজিএফ তথা দুস্থদের খাদ্য সহায়তা এবং ওএমএস তথা উন্মুক্ত বাজারে অপেক্ষাকৃত কম দামে চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির সহায়তা। গ্রামে ওএমএস কর্মসূচি না থাকলেও জিআর-ভিজিএফের পাশাপাশি রয়েছে ইউসিটি তথা নগদ সহায়তা, যা গত বছর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া হয়। কাজের বিনিময়ে খাদ্য বা কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচি রয়েছে গ্রামে। সেখানে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিও বিদ্যমান। অবশ্য ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে শহরেও চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু ইত্যাদি খাদ্যপণ্য বিতরণ করতে দেখা গেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং এ খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। বাজেটের আগে আমরা বলেছিলাম, করোনায় দরিদ্র মানুষের জন্য প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার সহায়তা দরকার। গ্রামের গরিব মানুষকে প্রতি মাসে এক হাজার ৪৫০ টাকা নগদ সহায়তা দিলে লাগবে ছয় হাজার ২৩২ কোটি টাকা। আর শহরের মানুষকে মাসে এক হাজার ৭৪৫ টাকা দিলে লাগবে চার হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে ১০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা লাগবে। আমাদের গবেষণায় এসেছে, করোনার কারণে দরিদ্র মানুষের মধ্যে যারা গ্রামে আছেন, তাদের ৬৭ শতাংশের নগদ ও ৭০ শতাংশের খাদ্য সহায়তা দরকার। আর শহরের বস্তিবাসীর ৭০ শতাংশের নগদ ও ৭৮ শতাংশের খাদ্য সহায়তা দরকার।
করোনা অতিমারির পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য নিরসনের কৌশলগুলোর বিষয়ে নতুন আঙ্গিকে ভাবা দরকার। এ ক্ষেত্রে তিনটি অগ্রাধিকার বিবেচনা করা দরকার- নগর দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, নতুন দরিদ্রদের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের সুরক্ষায় নীতিগত উদ্যোগ নেওয়া। নগর দরিদ্রদের আয়ের সুযোগ বেশি হলেও শিশুশিক্ষা, পুষ্টি ও টিকাদানে তারা পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে গ্রামীণ দরিদ্রদের আয় কম হলেও সামাজিক সূচকে তারা এগিয়ে আছে। কারণ, নগরের সামষ্টিক ও ব্যষ্টিকের সংযোগ অর্থনীতিতে বিপুল কর্মসংস্থান রয়েছে। জিডিপির বড় একটি অংশের জোগান এরাই দিচ্ছে। তাই এই খাতের উন্নয়ন ছাড়া এই মানুষের জীবনে স্থিতিশীলতা আসবে না। বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি মূলত গ্রামীণ দরিদ্রদের কেন্দ্র করে প্রণীত হয়েছে। অথচ করোনায় নতুন দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনে অভিঘাত অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবনমান উন্নয়নে জোর দেওয়া উচিত।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে 'কঠোর লকডাউন' আসছে। মনে রাখা দরকার, স্বাস্থ্য সংকট ও অর্থনৈতিক সংকট- এই দুটিই আমাদের সামাল দিতে হবে। লকডাউন সত্ত্বেও অত্যাবশ্যকীয় সেবা চালু থাকবে, কিন্তু এর একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। লকডাউন হয়েছে সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও কিন্তু তার সুফল কেন সেভাবে আসেনি, কেন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি এ নিয়ে ভাবা দরকার; যাতে আরও কার্যকর কর্মসূচি নেওয়া যায়।
অর্থনীতিবিদ ও এক্সিকিউটিভ, চেয়ারম্যান, পিপিআরসি