দেশ পরিচালনায় আমলাদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা নিয়ে সোমবার জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য যে 'কঠোর সমালোচনা' করেছেন, সেটাকে বিচ্ছিন্ন আলোচনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে আমলারা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে- এমন আলোচনা ও সমালোচনা অনেক দিন ধরেই জনপরিসরে শোনা যাচ্ছে। এখন সেটা দেশের আইনসভায়ও উত্থাপিত হলো মাত্র। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ যথার্থই বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম বা 'ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স' অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের স্থান সচিবদের ওপরে। এটাও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রেই এই পদমর্যাদাক্রম দৃশ্যতই মানা হয় না। সাম্প্রতিক যে বিষয়টি নিয়ে তিনি মুখ্যত আপত্তি তুলেছেন, সেখানেও এর ব্যত্যয় ঘটেছে। মাঠ পর্যায়ে করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকারি কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবের ওপর ন্যস্ত করে গত এপ্রিলে দাপ্তরিক আদেশ জারি করা হয়েছে। তোফায়েল আহমেদ প্রশ্ন তুলেছেন, জেলায় জেলায় সংসদ সদস্যরা থাকা সত্ত্বেও সরকারের এই ব্যবস্থা সংগত কিনা। আমরা মনে করি, বিলম্বে হলেও এই বিতর্কের সুরাহা হওয়া উচিত। সেদিক থেকে জাতীয় সংসদই যথোপযুক্ত স্থান। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এর সমাধান সহজ নয়। কারণ, সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মধ্যেও আমরা একই ধরনের 'সীমানা বিরোধ' দেখে এসেছি। সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক দায়িত্ব আইন প্রণয়ন হলেও স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে তাদের 'ভূমিকা' অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের ক্ষুব্ধ করে থাকে। সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির বিরোধের জের ধরে উন্নয়ন প্রকল্প বছরের পর বছর আটকে থাকছে- এমন নজিরও কম নেই। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের পক্ষে 'প্রশাসনের বাড়াবাড়ি' নিয়েও অভিযোগ উঠতে দেখা গেছে। বিশেষত গত বছর দেশের কোথাও কোথাও 'অনিয়ম ও দুর্নীতি' নিয়ে জনপ্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। আমাদের মনে আছে, গত বছর জুন মাসে সমকালেই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর তার আগের তিন মাসে শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এই যখন চিত্র, তখন আমরা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের শরণাপন্ন হতে পারি। তার রচিত এই চরণ এখন বাংলা প্রবাদে পরিণত হয়েছে- 'যার কর্ম তারে সাজে/ অন্য লোকের লাঠি বাজে।' বস্তুত জনপ্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি যদি নিজ নিজ এখতিয়ার মেনে চলে, তাহলে কোনো গোলযোগ ঘটে না। এতে করে একদিকে যেমন দেশ পরিচালনা সুচারু হয়, তেমনি অহেতুক বিরোধের মীমাংসাও সহজ হয়। আমরা জানি, এখতিয়ারবহির্ভূত তৎপরতা থেকেই অনিয়মের জন্ম হয়। এটাও ভুলে যাওয়া চলবে না- এখতিয়ারই শেষ কথা নয়। এর সঙ্গে সামর্থ্য ও যোগ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যখন আর্থসামাজিকভাবে এগিয়ে চলছে, তখন রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ও সরকারি ব্যবস্থাপনাও ক্রমে বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে তাল মেলাতে হলে আগের মতো কেবল জনপ্রিয়তাই যথেষ্ট নয়, জনপ্রতিনিধিদের ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতাও জরুরি। আমাদের সংসদ সদস্য কিংবা স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের তাই দক্ষতা বৃদ্ধির কথা দীর্ঘ মেয়াদে হলেও ভাবতে হবে। তার চেয়েও বেশি ভাবতে হবে সততা ও সদিচ্ছার কথা। জনপ্রতিনিধি বা জনপ্রশাসন- সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে থাকতে হবে শূন্যসহিষ্ণুতা। রাজনৈতিক রং বা প্রশাসনিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন, দুর্নীতি ও অনিয়ম করলে ছাড় দেওয়া চলবে না। আমরা মনে করি- জনপ্রতিনিধি বা জনপ্রশাসন, উভয়ই জনগণের সেবক মাত্র। যারাই জনস্বার্থ বিঘ্নিত করবে, যারাই জনগণের অধিকার ও প্রাপ্য অস্বীকার করবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, জাতীয় সংসদে যেমন সংসদ সদস্য ও আমলাদের এখতিয়ার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তেমনি সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের এখতিয়ার নিয়েও খোলামেলা আলোচনা হোক। জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে বাংলাদেশ এগিয়ে যাক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ৩০ জুন ২১ । ০০:০০ । প্রিন্ট সংস্করণ
মন্তব্য করুন