রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা হারান কখন? আমাদের ইতিহাসে যখন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে, যেমন পাকিস্তান আমলে দুইবার ও স্বাধীন বাংলাদেশে দুইবার ঘটেছে।
গত তিরিশ বছর দেশে মার্শাল ল আসেনি। মাঝে ২০০৭-০৮ সালে একটি অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পেছনে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল। তাছাড়া টানা রাজনৈতিক শাসন রয়েছে। কিন্তু এই সময়ে মাঝে-মধ্যে আমরা রাজনৈতিক নেতাদের কণ্ঠে 'রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে' বলে দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই। কে তাদের হাত থেকে রাজনীতি কেড়ে নিচ্ছে?
সর্বশেষ এই আক্ষেপটি উচ্চারিত হয়েছে খোদ জাতীয় সংসদে সম্প্রতি বাজেট আলোচনার সময় সরকারি দল আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদের মতো বর্ষীয়ান, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতার কণ্ঠে। তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান বিরোধী দলে বসা জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ ও রুস্তম আলী ফরাজী এবং গণফোরামের মোকাব্বির খান। অনির্ধারিত আলোচনায় দাঁড়িয়ে সরকারি জোটভুক্ত জাসদের নেতা হাসানুল হক ইনুও কথা বলেন।
তাদের ক্ষোভমিশ্রিত বক্তব্যের মূল বিষয় হলো, দেশ পরিচালনার কাজে সরকার আমলাতন্ত্র-নির্ভর হয়ে পড়ছে এবং রাজনীতিবিদদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমলা তথা সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার সূত্রে কতিপয় আমলার বাড়াবাড়ি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের উল্লেখ করেন তাদের কেউ কেউ।
বক্তব্যের সূচনাকারী ও ব্যক্তির গুরুত্বের দিক বিবেচনায় আমরা তোফায়েল আহমেদের কথার ওপর প্রধানত আলোকপাত করি। তিনি সাবেক সেনানায়ক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সুপরিজ্ঞাত উক্তি স্মরণ করেছেন যে, তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবেন। তোফায়েলের মতে, জিয়া 'অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটা করেছেন।'
জিয়াউর রহমানের এই বহুল উদ্ধৃত উক্তিটি গত ৪০ বছর ধরে বহুবার উদ্ধৃত হয়ে আসছে। অর্থাৎ ১৯৮১ সালে জিয়া নিহত হওয়ার পরের চার দশকে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে দুই দফায় সাংবিধানিক সাড়ে চার মেয়াদে মোট ১৭ বছর ক্ষমতায় থেকেও জিয়ার ওই কীর্তিটি নাকচ করে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি সহজ করতে পারেনি। এটা স্বীকার করা হলো।
এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ দেশের পঞ্চাশ বছরে আমলাতন্ত্রের বিকাশ, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক ও সে ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকলে তার স্বরূপ ও সমাধান, সংবিধান অনুসারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কাছে আমলাতন্ত্রের জবাবদিহি প্রক্রিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি, ঘাটতি থাকলে তার প্রতিবিধান ইত্যাদি মৌলিক ও বড় পরিসরে কথাটা বলেননি। বলেছেন একটি ক্ষুদ্র পরিসরে, তা হলো বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারির সময় এ সংক্রান্ত কাজের সমন্বয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রতি জেলায় একজন করে সচিব স্তরের আমলাকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে। এর মধ্যে ত্রাণ সাহায্য বিতরণ একটি কাজ, যার দায়িত্বে আছেন জেলা প্রশাসকরা। জেলায় জেলায় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব প্রদান ও ত্রাণ সহায়তা বিতরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, '...মানুষ মনে করে আমরা যা দেই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন।' তিনি বলেন, সংসদ সদস্যরা নিজের অর্থ ব্যয় করেও অভাবী মানুষকে রিলিফ দিয়েছেন। অথচ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এলাকায় যান না। তার কথায়, 'একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব, কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।' তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা রাষ্ট্রের পদমর্যাদাক্রম হচ্ছে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে।

পদমর্যাদাক্রম নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাজনীতিবিদদের অবস্থান ম্লান হয়ে যাবে কেন? আমরা ঔপনিবেশিক সূত্রে বা ব্রিটিশদের ব্যবস্থায় যে আমলাতন্ত্র পেয়েছি তার মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই প্রশাসনযন্ত্র রাষ্ট্রে স্থায়ী, জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় সরকার পরিবর্তন করতে পারে, আর সেই নির্বাচিত সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে স্থায়ী চাকরিতে থাকা আমলারা, যারা জনগণের করের টাকায় বেতনভোগী কর্মচারী। প্রশাসনিক কাজ করার জন্য অবশ্যই কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা দায়ী সরকারের কাছে, তাদের জবাবদিহি সরকারের কাছে।
এখন রাজনৈতিক সরকার যদি আমলাদের জবাবদিহি আদায় করতে না পারে, আমলারা যদি বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তবে সে দায় কার? কীভাবে দেশে সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে এবং রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরা পিছিয়ে পড়ছে?
এই আলোচনাও নতুন নয়, দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে এবং রাজনীতির পশ্চাদপসরণ অব্যাহত আছে। সংসদে তোফায়েল আহমেদসহ সরকারি ও বিরোধী দলের কয়েকজন সাংসদের একত্র অভিযোগের পর অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ, জনপ্রশাসনের অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠ সাবেক কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গের কিছু অভিমত পুনরায় প্রকাশ পেয়েছে। সাম্প্রতিক অতীত ও বর্তমানের অভিজ্ঞতা, ঘটনাবলি ও বিকাশধারা অনুসরণ করে সরকার ও আমলাতন্ত্রের সম্পর্কের অভিমুখটি নির্ণয়ের চেষ্টা করা যেতে পারে।
ফিরে যাই সামরিক শাসকদের কথায়। জিয়ার পরে এরশাদ। সামরিক শাসন একরকম হুকুমে চলা সামরিক-বেসামরিক আমলাদেরই শাসন। জবাবদিহি যা তা একমাত্র একনায়ক শাসকের কাছে। তাকে সন্তুষ্ট রেখে জনগণের ওপর আমলাদের দাপট অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে এরশাদ নিজ নিয়ন্ত্রণে বেসামরিক শাসন চালু করার পর্যায়ে নতুন গড়া উপজেলা পর্যন্ত বিচার বিভাগ সম্প্রসারণ করতে সরকারি কর্মকমিশন এড়িয়ে সরাসরি বহু ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেন। পরে তাদের ক্যাডারভুক্ত করেন। পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি হওয়াসহ প্রশাসনে বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, যা পরে বাড়তেই থাকে।
এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির জয়লাভের পর থেকে নতুন যে প্রপঞ্চ শুরু হয়, তা হলো দুই বড় দলের তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় রাজনীতি এবং ক্ষমতার টানাটানিতে প্রশাসনের দলীয়করণ। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগের ডাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয় থেকে বেরিয়ে এসে রাজপথে যে 'জনতার মঞ্চ' তৈরি করেন তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি-তর্ক-বাহাস থাকলেও তা থেকে যে পরবর্তীকালে প্রশাসনের বিস্টেম্ফারণ ঘটে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের জয়, ২০০১ সালে বিএনপির জয়, ২০০৬ সালের নির্বাচন বিলম্বিত হয়ে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠান এবং ২০১৪-এর নির্বাচন বিএনপির বর্জন ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত একতরফা নির্বাচন হয়ে আজ পর্যন্ত কালপর্বে প্রশাসনের অব্যাহত দলীয়করণ চলেছে। সরকার বদল হলেই কয়েকশ করে কর্মকর্তার ওএসডি (বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তথা কর্মহীন চাকরিজীবন) হওয়া, মেধা-দক্ষতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় বদলি-পদোন্নতি ইত্যাদি এই সময়ের ঘটনা। এতে কর্মকর্তারাও পেশাদারিত্ব খুইয়ে ফেলতে ফেলতে দলানুগত্য দেখিয়ে সুবিধা লাভে ঝুঁকে পড়তে থাকেন এবং রাজনীতিবিদরাও 'আমাদের লোক' হলেই তাকে ছাড় দিতে থাকেন।
দুই দলের সংঘাতপূর্ণ ক্ষমতার রাজনীতির সর্বশেষ ধাপটি আপাতত ২০১৮ সালের নির্বাচন, যার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এখন আর তেমন আলোচনাও হয় না। এর পর থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের প্রকাশ্য বক্তব্য ও আচরণে পর্যন্ত দলীয় ছাপ লক্ষ্য করা যায়। এই সরকারি কর্মকর্তারা তো লভ্যাংশ চাইবেনই।
এই সময়ে পুরো সরকার একান্তভাবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সকল মন্ত্রীই মন্ত্রণালয়ের প্রায় সকল কাজকেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সম্পন্ন হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন। নতুন অনভিজ্ঞ মন্ত্রীরাও এর একটা কারণ হতে পারেন, যাদের প্রধানমন্ত্রীও পুরো আস্থায় নিতে পারেন না। আমরা স্মরণ করতে পারি, গত বছর করোনা মহামারির সময় ত্রাণ বিতরণে, বিশেষত চালের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা কিছু কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছিলেন। এই সার্বিক পরিস্থিতির সুযোগ যদি আমলারা নিয়ে থাকে, তাহলে দোষ দেব কাকে?
শেষ কথা হলো, আমরা এমনটা দেখতে চাই না। বহু সৎ ও দায়িত্বশীল আমলা আছেন জনপ্রশাসনে, যারা করোনাকালে ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত কাজ করছেন। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও কম-বেশি দুর্দিনে জনগণের পাশে আছেন। কিন্তু সিস্টেমে যদি সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তা দেশের গণতন্ত্র, জবাবদিহি, নাগরিক অধিকার, সুশাসন কোনো কিছুর জন্যই ভালো হবে না। জনপ্রতিনিধিদের ওপর যদি জনগণের আস্থা কম হয়, তাহলে জনপ্রতিনিধিরা আমলাদের জবাবদিহি তলব করতে পারবেন না। তাই 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত' হওয়ার অবসান ঘটিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে আমলাতন্ত্র-নির্ভরতা ঘুচবে না।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক