হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলা সদরের বহিরাংশের চারদিকে ঐতিহাসিক গড়ের খালের সুবিন্যস্ত দীর্ঘ পরিধি বিদ্যমান। এর আয়তন আনুমানিক ৭ কিলোমিটার। প্রস্থ ক্ষীণ হয়ে আগের এক-তৃতীয়াংশও নেই বলে জানিয়েছেন বয়োবৃদ্ধজন! যুগ থেকে যুগান্তর ধরে এ খাল পেরিয়ে যেতে হয় ক্ষেত-খামারে কিংবা দূর-দূরান্তে কোথাও। ঐতিহাসিকরা এই খালটিকে ঐতিহাসিক ক্ষীণাঙ্গী নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন।

বানিয়াচংয়ের কেউ এ খাল দেখেননি- গ্রামে এমন খুব কম মানুষই রয়েছেন। বর্ষাকালে এই খাল দিয়ে নৌকা চালিয়ে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত, কিংবা বেড়াতে যেত একস্থান থেকে অন্যস্থানে। বর্ষা এলেই দেখা যেত এই খাল পেরিয়ে সারি সারি নৌকা চলেছে যার যার গন্তব্যে। নৌকাগুলোর মধ্যে থাকত বিয়ের নৌকা, বড় বড় ধানের নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকা, ডিঙি নৌকা, ঘাসের নৌকা। মাঝেমধ্যে স্রোতে ভেলাও ভেসে আসত। ছোটরা দৌড়ে তা ধরে নিয়ে পাড়ে ভিড়াত।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বানিয়াচং রাজ্যের রাজা গোবিন্দ সিংহের মধ্যে জগন্নাথপুর রাজ্যের শাসক বিজয় সিংহের প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ হতো। বানিয়াচংয়ের রাজা দশআনা অংশ দেওয়ার পরও যখন বারবার যুদ্ধ হতো, একপর্যায়ে জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহ দিল্লির দরবারে নালিশ করলে তার প্রার্থনা অনুযায়ী দিল্লির দরবার থেকে গোবিন্দ সিংহকে নেওয়ার জন্য বারবার দূত প্রেরণ করা হতো। একপর্যায়ে বানিয়াচংয়ের রাজা দূতকে অগ্রাহ্য করেন এবং তাকে পদাঘাত করেন। এ কারণে দিল্লির দরবার থেকে বানিয়াচং রাজধানী যে কোনো সময়ে আক্রমণ হতে পারে মনে করে রাজধানী বানিয়াচংকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য বানিয়াচংয়ের চারদিকে রাজা গোবিন্দ সিংহ আনুমানিক ১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দে এই ঐতিহাসিক পরিখা খনন ও মাটির বেষ্টনী গড়ে তোলেন। এই সুপ্রশস্ত খালই এক সময় গড়ের খাল নামে পরিচিতি লাভ করে।

গবেষক অধ্যাপক আফজাল চৌধুরী লিখেছেন, 'বানিয়াচংয়ের ভেতর দিয়ে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে গেছে ছোট-বড় খাল। লাখো জনতার ছায়া-সুনিবিড় বসত ভূমিকে বর্ষাকালে যদি কেউ সুখ্যাত ভেনিসের সঙ্গে তুলনা করেন তাহলে বিস্ময়ের কি আছে?' ইতিহাসবিদ সৈয়দ মোস্তফা কামাল লিখেছেন, 'ক্ষীণাঙ্গী নদীর মতো গড়ের খাল সমগ্র গ্রামটিকে আপন মমতা দিয়ে তার চারপাশে যেন বাহুবন্ধনে জড়িয়ে রেখেছে।'

গড়ের খাল এখন অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে। খালের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিরা কিয়দংশ দখল করে বাড়ি, পুকুর করে ফেলেছেন। তাতে খালের অস্তিত্ব ও জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পানি নিস্কাশনে বাধা পড়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, রাস্তাঘাট দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। বিলম্বে হলেও প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা খালটি উদ্ধারে নড়েচড়ে বসেছেন। ২০১৪ সালে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভায় সাবেক সহকারী কমিশনার কামরুল আলমকে আহ্বায়ক ও পুলিশ ইনস্পেক্টর লিয়াকত আলীকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সাবেক জেলা প্রশাসক কামরুল আলম বানিয়াচং পরিদর্শনে এসে গড়ের খালটি উদ্ধারের জন্য নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৮ মার্চ জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান মতবিনিময় সভায় গড়ের খাল উদ্ধার করে শিগগির পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা ব্যক্ত করেন।

বিশিষ্ট লেখক ও সাবেক উপসচিব ড. শেখ ফজলে এলাহি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'খাল বা নদী দখল হলে জলজ বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ঐতিহাসিক গড়ের খাল খনন করলে যেমন পানি নিস্কাশন হবে, তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধিত হবে, মাছের চাহিদা পূরণ হবে।' ঐতিহাসিক দেওয়ান মাসুদুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'এ খালটি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। খালটি পূর্ণ সংস্কার করলে গ্রামের মানুষ উপকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।' ঐতিহাসিক গড়ের খাল রক্ষা ও দখলমুক্ত করে ঐতিহ্য ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি স্থানীয়দের। এমন একটি খালের সার্বিক গুরুত্ব নিছক আর দশটা খালের মতো নয়।

লেখক ও লোক গবেষক