করোনার কশাঘাতে সারাবিশ্ব আজ পর্যুদস্ত। তবে করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কারের ফলে কিছু দেশ এখন বিপদমুক্তপ্রায়। আমরাও আশার আলো দেখছিলাম। কিন্তু মরীচিকার মতো তা মিলিয়ে গেল কেন- এমন অনেক প্রশ্ন আছে। করোনা অনবরত তার চেহারা পাল্টাচ্ছে। আজ ইংল্যান্ড ভ্যারিয়েন্ট তো কাল আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট এবং বর্তমানে আমাদের দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যে পরিবারে ঢুকছে, পুরো পরিবারকে তছনছ করে দিচ্ছে। শিশু, কিশোর, বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না।

উপসর্গ নিয়ে টেস্ট করতে দিয়ে দুই-তিন দিন পার হয়ে যায় ফলাফল পেতে। হাসপাতালে নমুনা দিয়ে এসে ফলাফল জানার আগে মৃত্যুও ঘটছে অনেকের। অথচ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এগিয়ে এসেছিল তাদের র‌্যাপিড টেস্টের গবেষণা নিয়ে। অ্যান্টিজেন টেস্টও করতে চেয়েছিল। সে সময়ে ডায়ালাইসিস করাতে আসা রোগীদের হয়েছিল চরম দুর্ভোগ। এই র‌্যাপিড টেস্ট এসব ডায়ালাইসিস রোগীদের জন্য করতে চেয়েও তারা তখন অনুমতি পাননি। আবার অ্যান্টিজেনের জন্য গবেষণার অনুমতিও তাদের দেওয়া হয়নি। অথচ আজ সেই অ্যান্টিজেনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বিদেশ থেকে কিট এনে চড়া মূল্যে। বিদেশ থেকে আমদানি করলে হয়তো শতকরা হিসাবে লাভ থাকে অনেকের।

২০ মে ২০২১ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে 'করোনার প্রতি টিকায় বেক্সিমকোর মুনাফা ৭৭ টাকা। সব খরচ বাদে টিকাপ্রতি এ মুনাফা কোম্পানির। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আমদানির জন্য চুক্তিবদ্ধ একমাত্র প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মা।' এই আমদানিতে পকেট ভরার সুযোগ থাকায় করোনার ভ্যাকসিন দেশে উৎপাদিত হোক- তা অনেকেই চান না। তাই নজর নেই দেশীয় গবেষণার দিকে, উৎপাদনের দিকে।

গত ১৭ জানুয়ারি করোনা প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন 'বঙ্গভ্যাক্স' মানব দেহে পরীক্ষা চালানোর জন্য বিএমআরসির (বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল) কাছে অনুমতি চেয়েছিল বাংলাদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ ফেব্রুয়ারি সবকিছু জমা দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। বিএমআরসির শর্ত ছিল ফেজ-ওয়ান ট্রায়ালের আগে বানর বা শিম্পাঞ্জির ওপর পরীক্ষা করতে হবে। তাদের দাবি অনুযায়ী এটি তাদের নিয়ম- যদিও এক সময়ে বিশ্বব্যাপী এটিই ছিল নিয়ম। কিন্তু করোনাকালে সেই নিয়ম তো ভাঙতে দেখলাম প্রায় সর্বত্র। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস পুতিন নিজের ও তার মেয়ের শরীরে ভ্যাক্সিন নিয়ে পরীক্ষার মাত্রা কমিয়ে আনলেন। বর্তমানে প্রায় সব ভ্যাক্সিনের বেলায় তাই হয়েছে। আর সে কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যাক্সিনের ওপর তাদের চিরাচরিত 'পুরোপুরি নিশ্চিত' কথাটি লিখছে না। মহামারি অবস্থায় ছাড় দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নাকি বানর ও শিম্পাঞ্জির ওপর টিকা দেওয়ার পর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কাগজপত্র বিএমআরসির কাছে জমা দিতে হবে। এরপর মানবদেহের ওপর ট্রায়াল চালানোর অনুমতি দেওয়া যেতে পারে বলে বিএমআরসি জানিয়েছিল। শিম্পাজির সংখ্যা ৯৯টি। এ কথাটি বলতে তো পাঁচ মাস সময়ের প্রয়োজন পড়ে না।

বহু আগে ইংল্যান্ডে প্লেগ রোগে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। দীর্ঘদিন পর তারা জানতে পেরেছিল, এই রোগের কারণ ইঁদুর। কিন্তু তারা তার আগেই শহরের সব বিড়াল ও কুকুর মেরে শেষ করেছিল। তাতে ইঁদুর আরও বেড়েছিল। আজ প্রায় সাড়ে চারশ বছর পর ইচ্ছা করলে বিড়াল-কুকুর মেরে ফেলা যায় না। তেমনি বানর ও শিম্পাঞ্জি নিয়ে ট্রায়ালের দিনও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। প্রকৃতিপ্রেমী পরিবেশবাদীরা বিশ্বব্যাপী এর বিরোধিতা করছেন। কাজেই ৯৯টি শিম্পাঞ্জি পাওয়া সহজ নয়। ভারতে ল্যাবরেটরি আছে। তারা দিতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশেও বানর ধরতে গিয়ে বিপত্তি ঘটেছে। কিন্তু বিজ্ঞান তো বাধা মানে না। নতুন আবিস্কার পুরোনো ধারণাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এই শতাব্দীর শুরুতে জীবের দেহকোষ, যাকে সোমাটিক সেল বলা হয়- সেই সেল বা কোষ থেকে ভেড়ার জন্ম দেওয়া হয়েছিল; অর্থাৎ স্ত্রীর ডিম্বাণু ও পুরুষের শুক্রাণু ছাড়া। যাকে বলা হয়েছিল ক্লোনিং পদ্ধতি। সেই ভেড়ার নাম রাখা হয়েছিল 'ডলি'। একই রকম আটটি ভেড়া পাওয়া গিয়েছিল। এই ভেড়া যে সন্তান জন্ম দিয়েছিল, তার নাম দেওয়া হলো 'পলি'। কাজেই এখন তো মানুষের দেহ কোষ বা সোমাটিক সেল দিয়ে পরীক্ষা চালানো যেতে পারে। এ কথাটি বঙ্গভ্যাক্সের বিজ্ঞানী ড. মহিউদ্দিন আহমদ এক টিভি চ্যানেলের প্রশ্নের উত্তরে বলতে চেয়েও বলতে পারেননি। বিএমআরসি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তা তো প্রায় ১০০ বছর আগের সিদ্ধান্ত। বিশ্ব মহামারির কারণে নানা চিন্তাভাবনা করছেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের ট্রায়াল বানরের ওপর না দিয়ে ইঁদুর বা গিনিপিগের ওপর দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। তাহলে বিএমআরসি বানর বা শিম্পাজির কথা বলে কীভাবে?

বঙ্গভ্যাক্স আবিস্কারের টিম লিডার কাঁকন নাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন- 'এই ভ্যাক্সিনের দুটো বৈশিষ্ট্য আছে। এটি খুব সম্ভবত সিঙ্গেল ডোজ ভ্যাকসিন হতে যাচ্ছে। এটি পৃথিবীর সমচেয়ে নিরাপদ ভ্যাকসিন হবে।' যে ট্রায়ালগুলো তারা করেছেন, তার ওপর ভিত্তি করেই তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, 'ভ্যাকসিনটি সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় যে, এই প্রথম আমরা মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে মৌলিক ডিজাইনের ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছি। এটি কোনো কপি ড্রাগ নয়। এটি পুরো দেশবাসীর গর্বের ব্যাপার।'

১৬ জুন ২০২১ একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়- 'অনিশ্চয়তার পথে বঙ্গভ্যাক্স টিকার অনুমোদন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ইথিক্যাল অনুমোদন চেয়ে ডিসেম্বরে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে আবেদন করা হলেও এখন পর্যন্ত তা অনুমোদন করা হয়নি।' আর বিএমআরসির সভায় বলা হয়েছে- 'বঙ্গভ্যাক্স নয়, দেশে করোনা টিকা অনুমোদনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।' এ আবার কেমন কথা? বিএমআরসির ইথিক্যাল কমিটির প্রধান ড. সাহেলা খাতুন জানান, 'প্রটোকলে তারা ইঁদুরের ট্রায়ালের ডাটা জমা দিলেও বানরের ওপর ট্রায়ালের বিষয়ে কোনো ডাটা জমা দেয়নি। তারা সাংবাদিকদের বলেছেন, এ ট্রায়ালের কোনো প্রয়োজন নেই।'

বানরের ওপর পরীক্ষার যে প্রয়োজন নেই, তা তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই বলে দিয়েছে। প্রশ্ন তো করতেই হয়- বিচারকের চেয়ারে বসে তিনি তা জানবেন না কেন? ডা. সালেহা খাতুন বলেছিলেন, 'ডিসেম্বরে তারা প্রটোকল জমা দিলে আমরা সেগুলো জাস্টিফাই করে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিলাম। তারা তার যথাযথ উত্তরসহ নতুন প্রটোকল দেননি। এ ছাড়াও হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে জানুয়ারিতে টিকা অনুমোদন বন্ধ রাখা হয়। আর এখানেই মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন- কে এই হাইকমান্ড, কার নির্দেশে দেশের গবেষণা, দেশের সৌভাগ্য ঠেকিয়ে দেয় শুধু ব্যক্তিস্বার্থে?

ডা. সালেহা খাতুনের প্রশ্নের উত্তরে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ড. মহিউদ্দিন বলেন, 'তাদের প্রশ্নগুলোর যথাযথ রেফারেন্সসহ জাস্টিফাই করে উত্তর দিয়েছি ১৭ ফেব্রুয়ারি। আমাদের রেসপন্স ঠিক আছে কিনা বা তারা স্যাটিসফাইড কিনা, তাদের প্রতিউত্তর না পেলে আমরা কীভাবে বুঝব। এমআরএনএ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে বানরের ওপর ট্রায়াল বা ডাটার প্রয়োজন নেই। আমেরিকার এমআরএনএ ভ্যাকসিন মডার্না এবং ফাইজারের ভ্যাকসিনগুলো কীভাবে ডেভেলপ এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করেছে এবং কোন পর্যায়ে কোন অ্যানিম্যালের ট্রায়াল করেছে, আমরা তা রেফারেন্সসহ জমা দিয়েছি।'

ফাইজার বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন এখন বিশ্ব কূটনীতির বড় শক্তি হিসেবে বিশ্নেষকরা মনে করছেন। একই প্রযুক্তির মেসেঞ্জার এমআরএনএ ভ্যাকসিন- এই বঙ্গভ্যাক্স। বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ঠাঁই হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রক্রিয়াধীন ভ্যাকসিন তালিকাতেও। অথচ নিজ দেশে তিন মাসের মধ্যে ফলাফল জানানোর কথা থাকলেও বিএমআরসি পাঁচ মাসেও ফলাফল জানায়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের দেওয়া হয়নি। এ কেমন কথা- দেশবাসীর দুর্দিনে তাদের সঙ্গে চরমতম দায়িত্বহীনতা নয় কি?

দেশে ভ্যাকসিন আবিস্কার সফল হলে নতুন উচ্চতায় উঠত বাংলাদেশ। সংকটের এই সময় আবিস্কারক প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে সহায়তা করার দরকার ছিল। অনুমতি পেলে বঙ্গভ্যাক্স সফল হতে পারে- প্রাথমিক গবেষণা প্রত্যক্ষ করে এমন মন্তব্য করেছিলেন অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দেশপ্রেমী, সৎ- সব মানুষ চায় করোনা থেকে মুক্তির জন্য দেশের গবেষকদের পাশে সরকার এগিয়ে আসবে-এ মৃত্যুর মিছিল থামাতেই হবে।

শেষ করতে চাই দেশপ্রেমের উদাহরণ দিয়ে। কিওরভ্যাক্স নামে জার্মানির একটি ভ্যাকসিন বঙ্গভ্যাক্সের পরে আবিস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল- সে দেশের সরকারের সহযোগিতায় ভ্যাকসিনটি এরই মধ্যে হিউম্যান ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভ্যাক্স এখন হিউম্যান ট্রায়ালের মাত্র প্রথম ধাপ শুরু করার আবেদন করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়- তারা যে দেশের স্বার্থ ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন, তার নিশ্চয়তা কতটুকু দেশবাসীকে জানালে ভালো হয়।

প্রাক্তন অধ্যাপক, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা