সারাদেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী গতির মধ্যেই ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করেছে। শর্তসাপেক্ষে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শপিংমল, হাটবাজার ইত্যাদি খোলা রাখার কথা বলা হলেও আমরা লক্ষ্য করছি, ঈদে ঘরমুখো মানুষ যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এমতাবস্থায় সংক্রমণের মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শুক্রবার সমকালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, ফেরিতে বালাই নেই স্বাস্থ্যবিধির। আমরা দেখেছি, দেশে টানা পাঁচ দিন ধরে দৈনিক দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে করোনায়। নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যাও কমছে না। জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্য, মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটতে পারে। সবার সুবিধার্থে সরকার লকডাউন শর্তসাপেক্ষে শিথিল করার পর মানুষ যেভাবে বেপরোয়া চলাচল করছে, তাতে ঝুঁকি বাড়বে নিঃসন্দেহে।

দীর্ঘদিন ধরে করোনার সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে এর প্রতিরোধে করণীয় বিষয়গুলো দেশের প্রায় সবাই কমবেশি জানেন কিন্তু অনেকেরই এসব মানার ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক অনীহা। আমরা মনে করি, এই প্রবণতা আত্মঘাতের শামিল। আমরা জানি, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেক ভয়ংকররূপে এসেছে। সংক্রমণ এখন আর গণ্ডিবদ্ধ নয়। তবে আতঙ্ক নয়, সচেতনতা-সতর্কতায় এ থেকে উত্তরণ সম্ভব। আগে সংক্রমণ শহরাঞ্চলে থাকলেও এখন তা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ংকরভাবে। আমরা দেখছি, গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় ঘটছে তুলনামূলক বেশি। তাই এবার সংক্রমণের গতি রোধ করা অপেক্ষাকৃত বেশি কঠিন হবে- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এই আশঙ্কা অমূলক নয় বলেই মনে করি।

আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই লিখেছিলাম, সংক্রমণের গতি রোধ করতে না পারলে সব ব্যবস্থার পরিসর বাড়িয়েও সুফল মিলবে না, তাতে ভেঙে পড়তে পারে চিকিৎসাব্যবস্থাও। তেমন পরিস্থিতি যাতে মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি না হয়, এজন্য নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের দায়িত্বশীল ভূমিকার বিকল্প নেই। গণপরিবহন যাতে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলে এবং মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ অনুসরণ করে, এজন্য প্রশাসনের কঠোর অবস্থান কাম্য। আমরা মনে করি, দায় যার যার কিন্তু দায়িত্ব সবার। আমরা দেখেছি, পর্যবেক্ষক-বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশ পরামর্শ সরকারের কাছে ইতোপূর্বে পেশ করেছেন এবং নীতিনির্ধারকরা এর পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে যথেষ্ট ঘাটতি থেকে যায়। লকডাউন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গেছে সমন্বয়হীনতা ও বিভ্রান্তি। ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের চাপ আগামী দু'তিন দিন আরও বাড়বে বলেই আমাদের অনুমান।

ধারণা করা যায়, ফেরার ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, ঈদের দু'দিন পরই আবার কঠোর বিধিনিষেধ থাকায়, এ শঙ্কা অমূলক নয় যে, ঈদের পর দিনই বাড়ি ফিরতে মানুষের ব্যাপক চাপ থাকবে। এজন্য সে সময় অতিরিক্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, প্রশাসন তা ভাবতে পারে। তবে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে যাতে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল করে, এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে। সার্বক্ষণিক প্রশাসনিক নজরদারি তীক্ষষ্ট রাখার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে মানুষকেও সচেতন-সতর্ক হতে হবে।

সরকারের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে গত ঈদে মানুষের ঘরে ফেরা ও ঈদ-উত্তর কর্মস্থলে ফিরে আসায় চরম বিশৃঙ্খলার কারণে আমরা বিস্ম্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। আমরা চাই, মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতায়াত করে এজন্য সরকারের সংশ্নিষ্ট সব মহল দায়িত্ব পালনে অধিকতর তৎপর হোক। ঘরে ফেরা মানুষ যাতে এলাকায় গিয়ে সচেতনতার অভাবের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি যাতে বাড়িয়ে না তোলে তাও নিশ্চিত করা জরুরি। উৎসব উদযাপনে সবাইকে থাকতে হবে সচেতন। অতীতের মতো বিশৃঙ্খলার বিবিধ রূপ আমরা দেখতে চাই না। সবাইকে মনে রাখতে হবে, কোনো কারণেই যাতে সামষ্টিক কল্যাণের অতি জরুরি বিষয় হুমকির মুখে না পড়ে। জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নয়- এ কথাটি যেন কেউই ভুলে না যাই। সারাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ, তাই দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণই করোনা সংক্রমণ রোধের রক্ষাকবচ।