
সম্প্রতি ভারতের পাঁচটি প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর কর্তৃত্ব খাটিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার, করোনা মহামারি উপেক্ষায়। ফলাফলও প্রকাশ হয়েছে। এতে একমাত্র আসাম ছাড়া অন্য রাজ্যগুলোতে জয়ী হতে পারেনি বিজেপি। আসামের রাজ্য ক্ষমতায় অবশ্য বিজেপিই ছিল, সেটা ধরে রেখেছে। কিন্তু করোনার সুযোগ হাতিয়ে রাজ্য ক্ষমতা দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মোদি সরকার। কিন্তু সে স্বপ্ন বা আশা পূরণ হয়নি এটা যেমন সত্য, তেমনি নিরাশারও কারণ নেই। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে তো বটেই।
নির্বাচন-পরবর্তী করোনা মহামারির প্রচণ্ড আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল দেশটি। হাজারো মানুষের মৃত্যু এবং শবদাহ বা কবর দেওয়ার সুযোগ না থাকায় নদীতে নিক্ষেপ করে সারা বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিল ভয়ংকর সেসব সংবাদ। তবে আশার কথা, তারা গণটিকা ও কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে ওই অবস্থা থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ও ভোটের হিসাবটি তলিয়ে দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। সাদা চোখে বিজেপির পরাজয় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিপুলসংখ্যক আসনে জয়ী হওয়ার বিষয়টি আপ্লুত হওয়ার বটে। কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি তলিয়ে দেখলে ওই আপ্লুত উচ্ছ্বাসে কালো মেঘের ছায়া নেমে আসে। অতীতের দিকে নজর ফেরালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে প্রথমবার বিজেপির ক্ষমতা গ্রহণের সময় তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী জোটবদ্ধ হয়ে লোকসভা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি মাত্র একটি আসন পেয়েছিল। জোটভুক্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকারের রেল ও কয়লামন্ত্রী হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় দফায় মোদির নেতৃত্বে লোকসভা নির্বাচনের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই নির্বাচনে তৃণমূল কোনো দলের সঙ্গেই জোটবদ্ধ না হয়ে একাকী নির্বাচন করেছিল। সে নির্বাচনে বিজেপি লোকসভার ৪২ আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয়ী হয়। তৃণমূল ২২টি এবং জাতীয় কংগ্রেস দুটি আসন লাভ করে।
গত বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন। এবারের বিধানসভার নির্বাচনে পেয়েছে ৭৭টি আসন। ২৯২টি আসনের এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২১৩টি আসন, বিজেপি ৭৭টি, আব্বাস সিদ্দিকীর দল একটি এবং অন্যান্য একটি। তৃণমূলের প্রাপ্ত আসনের গড় ৪৭%, বিজেপির ৩৮%। আসনের দিকটি বিবেচনা করলে তৃণমূলের বিজয়কে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরঙ্কুশ জয় বলে প্রতীয়মান হবে নিশ্চয়। কিন্তু দু'দলের প্রাপ্ত ভোটের দিকে নজর দিলে আঁতকে উঠতে হয়। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২ কোটি ৮৭ লাখ ভোট, বিজেপি পেয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখ ভোট। বিজেপির ৯২ জন প্রার্থী গড়ে মাত্র ৭০০ থেকে এক হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন।
লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডিই বটে। তৃণমূলের শাসনামলে সারদা, নারদা ও আম্পান-পরবর্তী দুর্নীতি-অপশাসন, সামগ্রিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একমাত্র সিপিএম বা বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকদের প্রতি চরম নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার ইত্যাদির পরও মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে কেবল বিজেপিকে রুখতে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ৩০% মুসলিম ভোট একচেটিয়া তৃণমূল লাভ করেছে। মুসলিম অধ্যুষিত সংসদীয় অঞ্চলে বিজেপি আসন শূন্য এবং বিশাল ব্যবধানে তৃণমূলের বিজয় দেখা গেছে। নয়তো তৃণমূলের শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবন-জীবিকার সামান্য পরিবর্তন সূচিত হয়নি। বরং নানাভাবে মানুষকে নাকাল হতে হয়েছে। বিজেপিকে ঠেকাতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে তৃণমূল ভোট পেয়েছে, তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, অপকীর্তির পরও।
এবারের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় তৃণমূলের সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু ওই সিপিএম বা বামফ্রন্ট। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিজেপি নয়। এ যাবৎ ১৪ জন বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থককে হত্যা, গৃহে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং অগণিতদের নৃশংস উপায়ে আহত করেছে। এর ধারাবাহিকতা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে চলছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ে বেশিরভাগ বাঙালি যখন আনন্দ-উল্লাসে ব্যস্ত, বিজেপির মতো একটা সাম্প্রদায়িক দলকে হারিয়ে, ঠিক সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে পরাজয় নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই মোদির। কারণ বাংলার মসনদ না পেলেও আসলে যে জিনিসটি তার অভাব ছিল সেটা পূরণ করে নিয়েছেন। কেউ মাথা ঘামাচ্ছেই না সেটা নিয়ে। বিজেপি রাজ্যসভা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। সেখানে বিজেপির পক্ষের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র '১১৮'। কিন্তু যে কোনো বিল পাস করিয়ে আইনে পরিণত করতে দরকার '১২৩' জনের সমর্থন। অধুনা আসাম, বাংলা, পন্ডিচেরিতে যে সংখ্যক বিধায়ক বাড়াতে পারল তাতে রাজ্যসভায় বিজেপির মনোনীত সদস্য সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল '১২৫'। অর্থাৎ এবারে সরকারবিরোধীরা আর কোনোভাবেই কোনো বিলকে আইনে পরিণত হতে বাধা দিতে পারবে না।
২০১৬ সালের নোটবন্দি থেকে হালের কৃষি বিল, মোদি সরকারের কোনো কাজ কোনো সিদ্ধান্তই গরিব এমনকি বড়লোকদের কোনো ক্ষতি ছাড়া উপকার করেনি, তার ওপর গোদের ওপর বিষফোড়া এনআরসি, সিএএ। এতদিন পর বিশুদ্ধ আইন হতে চলেছে, না মানলেই আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ অর্থাৎ সরকারের পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি। অর্থাৎ এক কথায় মোদি ও আরএসএস এখন অপ্রতিরোধ্য।
এরপর দেখা যাক অরুণাচল প্রদেশের ঘটনায়। সেখানে চীন একটি আস্ত গ্রাম বানিয়ে বসে আছে, সংবাদমাধ্যম পুরো এলাকার স্যাটেলাইট ইমেজ দেখিয়েছে সমগ্র দেশবাসীকে আর মোদি সরকার জানে না এটি হতে পারে না। গালোয়ান ভ্যালিতে চীনকে জবাব সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছিল বিহার রেজিমেন্টকে পাঠিয়ে। কারণ সামনে তখন বিহারের নির্বাচন ছিল, বিহারি লাশের দরকার ছিল। অরুণাচলেও জবাব দেবে ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতেই। কারণ আবার একটা লোকসভা নির্বাচনের জন্য বলিদান চাই, আর চীনের সঙ্গে যুদ্ধের বাড়তি পাওনা ভারতের কমিউনিস্টদের চীনের দালাল বলে রটিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া। এক ঢিলে তিন পাখি শিকার করা যাবে।
ভারতীয় জনগণের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ হতে সামগ্রিকভাবে চলমান ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন সবই হজম হচ্ছে কেবল হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে, ওই আশায়। গর্বের সেই হিন্দুরাষ্ট্র পেতে গেলে অনেক ত্যাগ স্বীকার তো করতেই হবে ভারতীয় জনগণকে। কেননা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়েই তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নরেন্দ্র মোদি সরকারকে অকাতরে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে।
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
মন্তব্য করুন