- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- নির্বিচার দূষণের নীরব ঘাতক
মাছের পেটে প্লাস্টিক কণা
নির্বিচার দূষণের নীরব ঘাতক
বাজার থেকে কেনা ১৫ প্রজাতির দেশীয় মাছের পরিপাকতন্ত্রে 'মাইক্রোপ্লাস্টিক' বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা পাওয়া গেছে- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে আসা এ তথ্যে আমরা উদ্বিগ্ন হলেও বিস্মিত নই। মৎস্যসম্পদের আধার দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়সহ বিভিন্ন জলাশয়ে বছরের পর বছর যে মাত্রায় পলিথিন বা প্লাস্টিক দূষণ চলছে, তাতে মাছের পরিপাকতন্ত্র আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভের অংশ হিসেবে পরিচালিত এবং পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টে প্রকাশিত এ গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে মিঠাপানির জলাশয়ে চাষ করা মাছ। আমাদের আশঙ্কা, দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎপন্ন মাছেও একই ধরনের দূষণ পাওয়া যেতে পারে। বস্তুত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলেই সমুদ্র, নদীসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর মধ্যে প্লাস্টিক দূষণের প্রমাণ ইতোমধ্যে মিলেছে।
বাংলাদেশে এর ব্যত্যয় ঘটার কারণ থাকতে পারে না। বরং মাত্রাগত দিক থেকে আমাদের দেশে দূষণ বেশিই হতে পারে। আরও আশঙ্কার বিষয়, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে সচেতনতা ও সক্রিয়তা ক্রমে বাড়লেও আমাদের দেশে বিষয়টি এখনও গবেষণা বা সংবাদমাধ্যমের আলোচনার বিষয় হিসেবেই রয়েছে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর প্লাস্টিক ও পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কেউ দ্বিমত না করলেও, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটি অনিষ্পন্নই রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের অপব্যবহার ও অতিব্যবহার রোধে যে উদ্যোগ ও প্রচারণা চলছে; বাংলাদেশ যেন তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। বিভিন্ন সময় গবেষণা প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে হতাশাজনক চিত্রই ফুটে ওঠে। স্বীকার করতে হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যারা প্রথম প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করেছিল; বাংলাদেশ ছিল তার প্রথম সারিতে।
আমাদের মনে আছে, ২০০২ সালে ৫৫ মাইক্রোনের নিচে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের বলে। ওই সময় পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছিল মূলত নগরের পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা সচল রাখার স্বার্থে। কারণ পরিত্যক্ত পলিথিন ব্যাগের কারণে রাজধানীর নালা-নর্দমা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কারণ যাই হোক, পরিবেশবাদী বিভিন্ন পক্ষ ও নাগরিকরা সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে এর সুফলও আমরা দেখেছি। কিন্তু নজরদারির অভাবে ফের বাজার ছেয়ে গেছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা নগরীতে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থায় যে ভারসাম্যহীনতা দেখছি, তা নিষিদ্ধ পলিথিনেরই দায় কিনা কে জানে! আমাদের এও মনে আছে, ২০১০ সালে আরেকটি আইনের মাধ্যমে পলিথিন বস্তার স্থলে চটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। সেই আইনও ক্রমে কাগুজে দলিলে পরিণত হয়েছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক পুনর্চক্রায়নের উদ্যোগ অবশ্য গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে ও বেড়েছে- অস্বীকার করা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে তা বুমেরাংও হয়েছে। অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্যের সঙ্গে হাসপাতালের বর্জ্য মিশিয়ে যে পুনর্চক্রায়ন চলে; সেখান থেকে তৈরি হওয়া নানা প্লাস্টিক পাত্রও যত্রতত্র পরিত্যক্ত হয়ে দূষণ বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে ক্যান্সারসহ নানা মারাত্মক রোগ-ব্যাধির যে ঝুঁকি তৈরি হয়, এ ব্যাপারে গবেষক ও স্বাস্থ্যবিদরা বহুবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেও আমরা একাধিকবার এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছি। কিন্তু সকলই গরল ভেল! এখন দেখা যাচ্ছে- 'মাছে ভাতে বাঙালি' জাতির মাছের মধ্যেই প্লাস্টিক দূষণ ঢুকে গেছে। ভাতেও এর কী প্রভাব পড়ছে, আমরা জানি না। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সুমাইয়া জান্নাত, তার গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ জানাই। প্রত্যাশা করি, এই গবেষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরাও এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় এগিয়ে আসবেন। বিলম্বে হলেও কর্তৃপক্ষের উচিত হবে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হওয়া। আমরা চাই, নিষিদ্ধ মাত্রার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণনের ওপর নজরদারি জোরদার করা হোক। একই সঙ্গে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন না হলে জেনেশুনে বিষ পান করে যেতেই হবে।
মন্তব্য করুন