নাটক শুধু সমাজের দর্পণই নয়; অনেক ক্ষেত্রে নাটক বিশেষ বিষয়ে সমাজের গতি নির্ধারণ করে দেয়। 'লালসালু' সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সমাজকে পথ দেখিয়েছে। বাকের ভাইয়ের অন্যায় ফাঁসির বিরুদ্ধে রাস্তায় জনগণের মিছিল এ দেশ প্রত্যক্ষ করেছে। এগুলো এ দেশের নাটকের স্বর্ণযুগের পরিচায়ক। কিন্তু বর্তমানে নাটকের গতিধারায় বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। ভিউ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য চলছে নাটকের নির্মাণ; সঙ্গে বাড়ছে শুধুই বাণিজ্য। নাটকের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট অল্পকিছু মানুষের সেই পুরোনো ধারা ধরে রাখার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে মাঝে মাঝে। তাদের নাটক-সিনেমার দর্শক কম। ঘটনা সত্য- নাটকের উপজীব্য ছিল পাপের ফল দেখানো। কিন্তু সেই পাপের ফল দেখাতে গিয়ে তারা আরেকটি বড় পাপ সামনে টেনে সমাজকে ভিন্নপথে চালানোর দায়বদ্ধতায় পড়েছে। সন্তান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বা স্পেশাল চাইল্ড হওয়াটা বাবা-মায়ের পাপের ফল বিবেচনা করে নাটকে দেখানো বাঙালি মৃতপ্রায় কুসংস্কারকে টেনে জীবিত করার শামিল।
প্রায় ২০ লাখ মানুষ নাটকটি দেখেছে অনলাইনে। এর আগে প্রচারিত হয়েছে দেশের একটি টিভি চ্যানেলে। সংক্ষুব্ধ অভিভাবকদের আপত্তির মুখে কর্তৃপক্ষ নাটকটি নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরানোর পরও প্রায় ২২ ঘণ্টা চলেছে ইউটিউবের অন্য একটি চ্যানেলে। ক্ষমাও চেয়েছেন কলা-কুশলীরা। তাতে লাভ কি কিছু হয়েছে? সর্বনাশ যা ঘটার তা তো ঘটেই গেল। বিষবাষ্প তো ছড়িয়েছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে।
দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল নাটকের কলা-কুশলীদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করে। তার পরিপ্রেক্ষিতে দর্শকদের একাংশ, বিশেষ করে যাদের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ সমাজ, তারা অটিজম বা প্রতিবন্ধিতাকে পাপের ফল প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছে। যে যেভাবে পারছে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব শিশুকে নিয়ে বিষোদ্গার করা হচ্ছে। সমাজে বিষবাষ্প ছড়ানোর এ দায় কি 'ঘটনা সত্য' টিম এড়াতে পারবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তা তাওহিদা বলেছেন, 'ঘটনা সত্য' নাটক নির্মাণ একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুযায়ী এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা সমাজে প্রচার করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া নাটকটির মাধ্যমে যে বার্তা সমাজে ছড়ানো হলো, তাতে এ ধরনের শিশু বা ব্যক্তিসংবলিত সব পরিবারকে সমাজে হেয় করা হলো, যা তাদের জন্য মানহানিকর।
বাংলাদেশ সরকার বেশ কয়েক বছর ধরে অটিজম ও প্রতিবন্ধিতা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কিন্তু সেসব প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্মিত হলো ভুল ও অবৈজ্ঞানিক বার্তাসংবলিত একটি নাটক। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন মানুষ ও তাদের পরিবার যার যার জায়গা থেকে এ অপমান ও ঘৃণ্য কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সোচ্চার, প্রতিবাদী ও সংগঠিত হচ্ছে, যা আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারছি। সমাজে ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক অপধারণা প্রচারের দায় 'ঘটনা সত্য'-এর স্ট্ক্রিপ্ট রাইটার, পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে বহন করতে হবে।
মাস্টার ট্রেইনার, অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ

dreamland019@yahoo.com

বিষয় : অন্যদৃষ্টি মো. আবু সাঈদ

মন্তব্য করুন