বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় ১৯৯৪ সালে ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-টিআরআইপিএস চুক্তির মাধ্যমে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) প্রবর্তন করা হয়। পণ্য বিপণনে বিশেষ করে রপ্তানি বাণিজ্যে ক্রেতাদের সহায়তা এবং উৎপাদকদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে কোনো দেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ গুণাবলিসম্পন্ন পণ্যকে ভৌগোলিক নির্দেশক রেজিস্ট্রেশন বা ট্যাগ প্রদান করা হয়, যা জিআই ট্যাগ হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে সমাদৃত পণ্যগুলো যা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছে কেবল সেসব পণ্যই জিআই ট্যাগের জন্য নির্ধারিত হয়।
ট্রেডমার্ক ও ভৌগোলিক নির্দেশকের (জিআই) মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। ট্রেডমার্ক হচ্ছে নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার ব্যক্তিমালিকানাধীন লোগো। আর জিআই হচ্ছে এলাকাকেন্দ্রিক উৎপাদিত পণ্যের সুনাম ও ঐতিহ্য। তাই বাণিজ্য ছাড়াও ঐতিহাসিকভাবে সমাদৃত পণ্য উৎপাদন এলাকায় পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন যশোরের কাঁচাগোল্লা অথবা কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদ আস্বাদনে লোকেরা ওইসব এলাকায় ভ্রমণ করে। ভারতের দার্জিলিং সফররত কেউ দার্জিলিংয়ের চা পান না করে কিংবা প্রিয়জনদের জন্য উপহার হিসেবে চা ক্রয় না করে ফেরেন না। ভারতের হায়দরাবাদি বিরানি ভোজন না করা পরিব্রাজক খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে ভারত ও পাকিস্তানের বাসমতি চাল, অস্ট্রেলিয়ার গুঁড়াদুধ, ভুটানের লাল চাল ও থাইল্যান্ডের জেসমিন চাল সারাবিশ্বে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত। জিআই ট্যাগ মূলত একটি আইনি সুরক্ষা। এটা উন্নত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎপাদককে অনুপ্রেরণা জোগায় এবং পর্যটন প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জিআই ট্যাগ রপ্তানি সক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ট্রিপস চুক্তির মাধ্যমে সব দেশকে নিজ নিজ এলাকায় উৎপাদিত পণ্য নিবন্ধনের অধিকারী করা হয়েছে। মেধাস্বত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন বাংলাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন 'পেটেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস অধিদপ্তর'কে জিআই পণ্য নিবন্ধনের অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৩ ও ২০১৫ সালে যথাক্রমে এ সংক্রান্ত আইন এবং বিধিমালা প্রণীত হয়েছে।
সাধারণত কৃষি, হস্তশিল্প, বাণিজ্যিক পণ্য এবং খাদ্য ও পানীয় পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর প্রথম জিআই সনদ পায়। ইলিশ মাছ ও ক্ষীরশাপাতি আম পরবর্তী সময়ে জিআই সনদপ্রাপ্ত হয়। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশি জিআই পণ্যের চহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশের ছয়টি ঐতিহ্যবাহী পণ্য যথা- কাটারিভোগ ও কালিজিরা (ধান), সিল্ক্ক ও মসলিন শাড়ি, সাদামাটি এবং শতরঞ্জি ২০২১ সালে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জিআই পণ্য তৃতীয় পক্ষকে বেআইনি উৎপাদন ও প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কিত ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করে। এটা নিম্নমানের পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় সম্পর্কিত অসৎ প্রতিযোগিতা প্রতিরোধে সহায়ক।
তিনটি ঐতিহ্যবাহী কৃষিপণ্য (ক্ষীরশাপাতি আম, কাটারিভোগ ও কালিজিরা ধান) জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা সিস্টেমের সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ক সংস্থা হিসেবে বিএআরসি ২০১৫ সাল থেকে ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উপযোগী জিআই পণ্য নিবন্ধীকরণে কাজ করে আসছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিল্পোন্নয়ন ও গবেষণা সমন্বয় কমিটির সঙ্গে বিএআরসি ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধীকরণে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিএআরসি ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী/কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সেমিনারের আয়োজন করে এবং জিআই কৃষিপণ্য স্বীকৃতির নিবন্ধীকরণে প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করার লক্ষ্যে নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের সহযোগে বিএআরসির সমন্বয়ে কমিটি গঠিত হয়।
পরবর্তী সময়ে দেশে পণ্যের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ও ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য নিবন্ধীকরণে বিএআরসি কর্তৃক সংশ্নিষ্ট নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে দাপ্তরিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়। শিল্প উন্নয়ন গবেষণা সমন্বয় কমিটির ষষ্ঠ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিএআরসি সংশ্নিষ্ট নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যগত গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের জিআই স্বীকৃতির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। জিআই আইন ও বিধিমালার আওতায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য এখন জিআই অন্তর্ভুক্তির দাবি রাখে। আশার কথা হলো, দেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্য ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে।
জিআই স্বীকৃতির ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ওইসব পণ্যের চাহিদা বহুলাংশে বাড়বে। ফলে চাঙ্গা হবে দেশীয় পণ্যের রপ্তানি বাজার। এসব বিচারে দেশের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের পাশাপাশি কৃষি বা কৃষিজাত উল্লেখযোগ্য পণ্য জিআই অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শীর্ষ সংস্থা হিসেবে বিএআরসি কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলোর জিআই স্বীকৃতি লাভে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
আমাদের দেশে জিআই বিষয়ে অনেকেই সম্যক অবহিত নন। তাই জিআই বিষয়ক ব্যাপক প্রচার, সচেতনতা ও গবেষণা প্রয়োজন। কৃষিশিক্ষা পাঠ্যক্রমে জিআই আইন ও প্রযুক্তিগত দিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং মেধাস্বত্ব বিষয়ে আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য যেমন- বাংলার কালো ছাগল, পাহাড়ি ঝাড়শিম বা হাটহাজারীর পুতা বেগুন, কিশোরগঞ্জের চ্যাপা শুঁটকি ও টেপি বোরো চাল, মহেশখালীর মিঠাপান, যশোরের কাঁচাগোল্লাসহ ঐতিহ্যবাহী এলাকাভিত্তিক নানা পণ্যের বিষয় বিবেচনা করা যায়। এতে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে দেশীয় জিআই পণ্যের গুণাগুণ প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্যের হিস্যাও বাড়ানো যাবে।
লেখকদ্বয় যথাক্রমে সদস্য পরিচালক (শস্য), বিএআরসি এবং প্রিন্সিপাল ডকুমেন্টেশন অফিসার, বিএআরসি

বিষয় : কৃষিপণ্যের জিআই স্বীকৃতি ড. মো. আজিজ জিলানী চৌধুরী ও ড. সুস্মিতা দাস

মন্তব্য করুন