করোনা মোকাবিলার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে টিকা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। টিকার আওতায় সব জনগোষ্ঠীর ভ্যাকসিন নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব। করোনা মোকাবিলায় যারাই সফলতা দেখাচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই এ অভিন্ন পথেই হেঁটেছে। এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে ক'মাস আগেও মৃত্যু ও শনাক্তে যে রেকর্ড আমরা দেখছিলাম, সেখান থেকে অবস্থার উত্তরণের পেছনেও টিকা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদেরও করোনা মোকাবিলায় টিকাকেই অগ্রাধিকার দিত হবে। মনে রাখতে হবে, এ টিকা কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। এ চিন্তা করা যাবে না- পাঁচ বছরে সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে ইত্যাদি। বরং পরিকল্পনা করতে হবে, কত দ্রুত মানুষকে টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা যায়। সংকটকাল বিবেচনা করে জরুরি ভিত্তিতে সবাইকে স্বল্প সময়ের মধ্যে টিকাদান কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা তিনটি- টিকা সরবরাহ, টিকা বিতরণ ও মানুষকে সচেতন করা।
প্রথমেই টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। টিকা না থাকলে তা কাউকে দেওয়া সম্ভব হবে না। যদিও এ ক্ষেত্রে প্রথমেই একটা ভুল হয়ে গেছে। আমরা একটি উৎসের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিন্তে ছিলাম। পরে দেখা গেল, তারা প্রত্যাশিত পরিমাণে টিকা দেয়নি। শুরু থেকেই যদি আমরা বহুমুখী উৎসে নজর দিতাম, তাহলে হয়তো টিকা নিয়ে মাঝখানে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল, তা হতো না। যা হোক, সেটা অতীত। এখন প্রশাসনের তরফ থেকে বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আনার প্রচেষ্টা চলছে। দেশে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এ পর্যন্ত সাতটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর মধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড, চীনের তৈরি সিনোফার্ম এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না- এ চারটি কোম্পানির টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে।
আমাদের মোট জনসংখ্যার টিকার আওতার অন্তত ১২/১৩ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হলে নূ্যনতম দুই ডোজ করে অন্তত ২৪ কোটি ডোজ টিকা দরকার। অথচ এ পর্যন্ত টিকা এসেছে দুই কোটির কিছু বেশি। এ পর্যন্ত টিকা সম্পন্ন করেছে এমন মানুষের সংখ্যা হিসাব করলে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি, সেটাও স্পষ্ট হবে। জুলাইয়ের পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দুই ডোজ টিকা দিয়েছে মাত্র ৪৩ লাখ মানুষ, যা আমাদের মোট জনসংখ্যার মাত্র আড়াই শতাংশ। তার মানে, জনসংখ্যার সামান্য অংশেরই টিকা নিশ্চিত হয়েছে। স্বল্প সময়ে সবার টিকা দিতে গেলে টিকার সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। এখানে বাড়তি পদক্ষেপ জরুরি। কেবল বিদেশের টিকার ওপর ভরসা করে থাকলে লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে। সে জন্য দেশীয় উৎপাদনে দৃষ্টি দিতে হবে। সেটা করতে হবে আমাদের বিদ্যমান অবকাঠামোর মধ্যেই। নতুন করে উৎপাদন করতে গেলে পাঁচ বছর কেন, ১০ বছরেও সবার টিকা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। সম্প্রতি সরকারের টিকা উৎপাদন পরিকল্পনার বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। খবর অনুযায়ী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারের একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি তথা ইডিসিএলের গোপালগঞ্জের কারখানাটির সক্ষমতাকে বিশেষ বিবেচনায় রাখছে। আমি মনে করি, ভবিষ্যতের জন্য দেশে আন্তর্জাতিক মানের টিকা ইনস্টিটিউট গড়তে এটি প্রয়োজন। তবে করোনার টিকা যেহেতু জরুরি ভিত্তিতে দিতে হবে, সে জন্য এখান থেকে উৎপাদিত টিকার ওপর নির্ভর করলে আমাদের হবে না। আমাদের জন্য ভালো বিকল্প হলো জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট তথা আইপিএইচ। আমরা জানি, তাদের নিজস্ব টিকা উৎপাদন ইউনিট রয়েছে। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিদ্যমান টিকা কাঠামো, জনবল ও গবেষক থাকার কারণে তাদের মাধ্যমে দ্রুত টিকা উৎপাদন করা সহজ হবে। টিকার উৎপাদন কিংবা প্রাপ্তিতে ধীরগতি তথা দ্রুত টিকা সরবরাহ করা না গেলে করোনা থেকে সুরক্ষা কঠিন হবে। দিন দিন করোনার ধরন বেড়ে গেলে আরও জটিলতা দেখা দেবে।


দ্বিতীয়ত, করোনার টিকা বিতরণে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও জরুরি। টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করে তা এনে রাখলেই হবে না; মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। করোনার মধ্যেও আমরা দেখেছি, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসামগ্রী এনে গোডাউনে ফেলে রাখা হয়েছে। এমনটি হলে মানুষের উপকারে আসবে না। মানুষ সহজে যাতে টিকা নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখছি, বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে টিকার জন্য নিবন্ধন করতে হয়। এভাবে করতে গেলে অনেকেরই সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ যারা ইন্টারনেটের বাইরে কিংবা যাদের এনআইডি নেই, তারাও যাতে টিকা নিতে পারে, সে জন্য টিকার নিবন্ধনে মিশ্র প্রক্রিয়া প্রয়োজন। তবে যেভাবেই দিক, একটি 'ডাটাবেজ' ব্যবস্থাপনা জরুরি। ডিজিটালি নিবন্ধনের পাশাপাশি বুথের মাধ্যমে কিংবা টিকাকেন্দ্রে নিবন্ধনের সুযোগ থাকা উচিত। এনআইডি না থাকলে ব্যক্তিকে শনাক্তের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যয়ন, জন্ম নিবন্ধন কিংবা অন্য কোনো প্রমাণপত্রের মাধমে 'ডাটাবেজ' নিশ্চিত করা চাই। টিকার উদ্দেশ্য যেহেতু মানুষের সুরক্ষা এবং এর সঙ্গে দুর্নীতি কিংবা ব্যক্তির সরাসরি অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয় নেই; সে জন্য এনআইডি বাধ্যতামূলক না করে সবাইকে টিকার আওতায় আনা উচিত। দেশে বিদ্যমান যে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই ব্যবস্থা রয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র কাজে লাগালে সবাইকে টিকা দেওয়া সহজ হবে। এমনকি অতি বয়স্ক এবং যারা চলাফেরা করতে পারেন না, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়ার বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে। ইপিআই কর্মসূচির জনবলকে কভিড টিকা বিতরণে কাজে লাগাতে তাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শুধু টিকা দেওয়াই নয়, বরং 'ডাটাবেজ' সংরক্ষণেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া চাই।
তৃতীয়ত, করোনার টিকা নিশ্চিতে মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, অনেকের মধ্যে টিকা বিষয়ে অনীহা যেমন রয়েছে, তেমনি বিভ্রান্তিও। এসব দূর করতে জনসচেতনতা কার্যক্রম প্রয়োজন। শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই টিকা কার্যক্রমের শুরুতে জনগণের সন্দেহের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। তা দূর করার জন্য অনেক দেশে শুরুতে দায়িত্বশীল বা সরকারপ্রধানদের টিকা নেওয়ার নজিরও দেখা গেছে। জনসচেতনতার পাশাপাশি মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে টিকা না দিলে কী কী সমস্যা হতে পারে, তাও বোঝাতে হবে। টিকা না দিলে দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না কিংবা একজনের কারণে অন্যরাও ভুক্তভোগী হতে পারে ইত্যাদি বুঝিয়ে চাপ দিয়ে হলেও টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের যাতায়াতে সহযোগিতা, শাস্তি প্রদর্শন কিংবা প্রণোদনা হিসেবে উপহার দেওয়ার পরিকল্পনাও প্রশাসন নিতে পারে।
টিকা ব্যবস্থাপনা একটি বিশাল ও 'টাইম সেন্সিটিভ' কর্মযজ্ঞ বলে এ কাজ পরিচালনায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আলাদা ব্যবস্থাপনা কাঠামো গঠন করলে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে। স্বাস্থ্য বিভাগের চিন্তাধারা যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে প্রতীয়মান, তারা টিকাদান কর্মসূচিকে আরেকটি পাঁচশালা পরিকল্পনা হিসেবেই দেখছে। এই চিন্তাধারা আত্মঘাতী। 'দ্রুত ও কার্যকর টিকাদান'- এ স্লোগান নিয়ে এগোতে হলে একটি আলাদা তৎপর কাঠামো ছাড়া সম্ভব হবে না। দেশের বিদ্যমান টিকার অবকাঠামো ও জনবলের পাশাপাশি কাজটি সহজ করতে অন্যদেরও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এনজিওগুলোর পাশাপাশি প্রযুক্তিবিদসহ অন্যদের অংশগ্রহণ টিকা কার্যক্রমে বিশেষ গতি আনতে সক্ষম হবে।
করোনার দ্বিতীয় ভয়াবহ ঢেউ আমরা দেখছি। এরই মধ্যে লকডাউনের কারণে দেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। একটানা দীর্ঘমেয়াদি বন্ধে থমকে আছে শিক্ষা কার্যক্রমও। অর্থনীতিসহ দেশের সব খাতে গতি আনতে টিকার বিকল্প নেই। অন্যান্য দেশ, যারা অর্থনীতিসহ সব কার্যক্রম নতুন করে চালু করেছে, তাদের অনুকরণে আমাদেরও টিকাকেই অগ্রাধিকারে রাখতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি