- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- নিমজ্জিত হিমশৈলীর ভাসমান চূড়া
শিবিরের রোহিঙ্গা লোকালয়ে
নিমজ্জিত হিমশৈলীর ভাসমান চূড়া
কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকায় নির্ধারিত বিভিন্ন আশ্রয় শিবির থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণ জনবসতিতে মিশে যাচ্ছে- এ অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু টেকনাফ পৌরসভার একটি ওয়ার্ডেই বেআইনিভাবে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১৮৩ জন চিহ্নিত হয়েছে- সোমবার সমকালে প্রকাশিত এমন খবর আমাদের যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনই বিস্মিত করেছে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের জন্য নির্ধারিত শিবিরের বাইরে যাতে বসতি গড়ে তুলতে না পারে, সে জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে নজরদারি রয়েছে। তারপরও মাত্র একটি ওয়ার্ডে এত সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রীতিমতো বাসা ভাড়া করে 'স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে' বসবাস করছে কীভাবে! আমরা আশঙ্কা করি, এই চিত্র নিমজ্জিত হিমশৈলীর ভাসমান চূড়া মাত্র। খোদ পৌর এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় যদি এই চিত্র হয়, তাহলে অন্যত্র কী ঘটছে, বলাই বাহুল্য। এটা নিরাপত্তা ও নজরদারি- দুই ক্ষেত্রেই উদ্বেগজনক। আরও হতাশার বিষয়, একটি ওয়ার্ডে রোহিঙ্গা উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্যোগে।
স্থানীয় একজন নেতা কাকতালীয়ভাবে বিষয়টি লক্ষ্য করে তালিকা প্রস্তুত এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করেন। আমাদের প্রশ্ন- প্রশাসন তাহলে কী করছে? আমরা দেখতে চাইব- বিলম্বে হলেও বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়দের মধ্যে 'মিশে যাওয়া' রোহিঙ্গাদের শনাক্ত, তালিকা প্রণয়ন এবং শিবিরে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি করেছে প্রশাসন। আমাদের মনে আছে, শরণার্থীদের নিয়ে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বয়ক গ্রুপ আইএসসিজির বরাতে গত বছর আগস্টে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে অবস্থিত অস্থায়ী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে দুই লাখের বেশি 'উধাও' হয়ে গেছে। তাদের একটি অংশ যে এভাবে জনসাধারণের মধ্যে মিশে গেছে- টেকনাফ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আলোচ্য তালিকা তার প্রমাণ। এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, সাধারণ জনপদ থেকে ভৌগোলিকভাবে অবিচ্ছিন্ন শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের আটকে রাখা সহজ নয়।
যে কারণে শিবির ত্যাগ করে অন্যত্র আত্মগোপনের খবর আমরা বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। রোহিঙ্গারা রীতিমতো বাংলাদেশি পাসপোর্ট বাগিয়ে বিদেশেও গমনাগমন করেছে। কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম অঞ্চলের শহরগুলো শুধু নয়; খোদ রাজধানী বা কক্সবাজার থেকে দেশের দূরবর্তী অন্যান্য জনপদেও রোহিঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার খবর বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে। রোহিঙ্গাদের এভাবে দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়া আর্থসামাজিক দিক থেকে নেতিবাচক তো বটেই, নিরাপত্তার দিক থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রবণতা আর চলতে দেওয়া যায় না। আমরা আশঙ্কা করি, শুধু রোহিঙ্গাদের স্বউদ্যোগে এই বেআইনি তৎপরতা সম্পন্ন হয়নি। এর সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত থাকতেই পারেন। বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের এনআইডি প্রাপ্তি ও পাসপোর্ট তৈরির অঘটন শনাক্ত ও উন্মোচিত হওয়ার পর এসব চক্র জড়িত থাকতে দেখেছি আমরা। তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। আমরা মনে করি, বিলম্বে হলেও রোহিঙ্গাদের শিবিরে অবস্থান যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
একই সঙ্গে শিবির থেকে চলে যাওয়া রোহিঙ্গারা কোথায় গেছে, এ ব্যাপারে অনুসন্ধান ও নজরদারি জোরদার করতে হবে। আবার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়াও জোরদার করতে হবে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ওই অস্থায়ী আবাসে যাওয়ার বদলে যেসব রোহিঙ্গা এভাবে জনস্রোতে মিশে যেতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য সৎ হতে পারে না। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা হলে তাদের পক্ষে ওই বাসস্থান ত্যাগ করা সহজ হবে না। তার বদলে যদি শিবিরেই রাখা হয় এবং এভাবে ক্রমেই জনসাধারণের মধ্যে মিশে যেতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ভারসাম্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হতেই থাকবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দশকের পর দশক ধরে যে রাষ্ট্রীয় ও জাতিগত নিপীড়ন চলছে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চয়ই সহানুভূতিশীল। কিন্তু এটাও সত্য, আমাদের বিপুল অব্যবহূত ভূমি নেই যে, একটি জনগোষ্ঠী অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকতে পারবে। বরং শিবিরের বাইরে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়লে অপরাধ ও বেআইনি কর্মকাণ্ডও সম্প্রসারিত হবে। এই ঝুঁকি বাংলাদেশ নিতে পারে না।
মন্তব্য করুন