করোনা এখন এক সামাজিক সংকটের নাম। উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত- সব দেশেই এ সংকট দৃশ্যমান। ধনী দেশগুলো আপাতত বিপদ থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেলেও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে নিয়মিত উপার্জনহীন মানুষ করোনাকালে সবচেয়ে বিপদের মুখোমুখি। কাজ হারানো লোকশিল্পীদের এখন চরম দুর্দিন। বাংলাদেশে লোকশিল্পীর সংখ্যা কত, এর পরিসংখ্যান এখনও তৈরি হয়নি। এমনকি শিল্পকলা একাডেমিও এ বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান দিতে পারবে না। প্রতিনিয়ত এসব শিল্পীর সংখ্যা বাড়ে এবং শিক্ষানবিশিকালেই তারা পেশাদার শিল্পী হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে এক প্রকার পেশাজীবী সংগীতশিল্পী আছেন, যাদের মূল পেশাই হলো সংগীতের মাধ্যমে মানুষকে বিনোদন দেওয়া। তারা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ শিল্পীরা আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে সরকার লোকশিল্পীদের করোনাকালে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু সরকারি হিসাব কিংবা শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতার বাইরেও অজস্র শিল্পী আছেন, যারা এ প্রণোদনার বাইরে রয়ে গেছেন। এমন অনেক শিল্পী আছেন, যাদের সঙ্গে শিল্পকলা একাডেমির কোনো সংযোগ নেই।

বাংলাদেশে অষ্টকগান, রামায়ণগান, পালাগান, গাজীরগান, গম্ভীরাগান, আলকাপগান, কবিগান- এসব লোকধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক শিল্পী আছেন, যাদের একমাত্র পেশা গান গাওয়া। করোনাকালে তারা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছেন। কণ্ঠশিল্পী ছাড়াও আছেন লোক ও কারুশিল্পীরা। করোনাকালে লোক ও কারুশিল্পও হুমকির মুখে। বাজার নেই, ক্রেতা নেই। ফলে শিল্পের কদরও নেই। হুমকির মুখে বাংলাদেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্প। পাওয়ারলুমের অবস্থা একটু ভালো হলেও হস্তচালিত তাঁতশিল্পীদের অবস্থা খুব খারাপ। রাজশাহীর শখের হাঁড়ির কারিগরদের টিকে থাকাই এখন কঠিন। শখের হাঁড়ির কারিগর সুশান্ত পাল অসুস্থ। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তিনিই একমাত্র শিল্পী, যিনি পাহাড়পুর ও মহাস্থানগড়ের মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জের একতারা নির্মাণশিল্পীরা বেকার। রংপুরের ধোকড়া ও বাঁশের ছাদ নির্মাণশিল্পীদের চরম দুর্দিন। একই অবস্থা সারাদেশের বাদ্যযন্ত্র নির্মাণশিল্পীদের। যশোর, শেরপুর, জামালপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নকশিকাঁথার গ্রামগুলোতে এখন কোনো কাজ নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও কোনো পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে না। শেরপুর, জামালপুরে আয়েশা-আবেদ ফাউন্ডেশন কিছুদিন পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও এখন তা বন্ধ। সিলেটের বাঁশ-বেতশিল্পীরাও বেকার। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মৃৎশিল্পীদের।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কণ্ঠশিল্পীদের আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকার ভাবনগর ফাউন্ডেশন ও যশোরের মুক্তেশ্বরী ফোকলোর ইনস্টিটিউট লোকশিল্পীদের সহযোগিতা দিয়েছে। সরকারও কিছু প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু পেশা হারানো সব লোকশিল্পী সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হননি। এমনকি অনেক কণ্ঠশিল্পীও এসব সহযোগিতার বাইরে থেকে গেছেন। বাংলাদেশ সরকার শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এ প্রণোদনার সুবিধাভোগী হিসেবে লোকশিল্পীদের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সরকারি নানা রকম সুযোগের মধ্যে লোকশিল্পীদের আলাদাভাবে গণ্য করা যেতে পারে। অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে দুস্থ লোকশিল্পীদের। শিল্পকলা একাডেমি কিছুটা চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে চেষ্টার মধ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কিছু অস্বচ্ছতা দেখা দিয়েছে। এখন প্রয়োজন নতুন তালিকা প্রণয়ন। এ বিষয়ে ভাবনগর ফাউন্ডেশন ও মুক্তেশ্বরী ফোকলোর ইনস্টিটিউটের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সাংবাদিকরাও একটা বড় রিসোর্স পারসন হতে পারেন। আমাদের লোকশিল্প বিশ্বের শিল্পবোদ্ধাদের আকর্ষণ করে। ইতোমধ্যে ইউনেস্কোসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের লোকশিল্পকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের মাধ্যমে আমাদের লোকশিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছে। আমাদের তাঁতশিল্প, নকশিকাঁথা, শখের হাঁড়ি, কারুশিল্প, সুচিশিল্প, বাদ্যযন্ত্রসহ নানা শিল্পদ্রব্য বিদেশিদের আকৃষ্ট করেছে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দেশের বাইরে এগুলোর বাজার তৈরি হয়েছে, যা আমাদের অত্যন্ত গর্ব, গৌরব ও অহংকারের। লোকশিল্পীরা নিজেদের কাজের বাইরে আর কোনো কাজে যুক্ত নন। এমনকি অনেকে বংশপরম্পরায় একই পেশায় যুক্ত। লোকশিল্প যেহেতু হঠাৎ সৃষ্টি হয় না এবং এর মধ্যে একটা পরম্পরার যোগ থাকে; তাই তাদের অন্য কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ারও সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশের লোকশিল্পীদের একটা তালিকা প্রণয়ন জরুরি। তাদের সহায়তার জন্য প্রয়োজন সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ।

সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী
ruanupam@gmail.com