এটি মোটামুটি প্রমাণিত- বাচ্চারা, একেবারে শিশুকাল থেকে অন্তত ১০-১২ বছর পর্যন্ত, বাবা-মায়ের পর যাদের কথাকে সবচেয়ে বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং যাদের দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত হয়, তারা আর কেউ নন; তাদের শৈশব-কৈশোরের শিক্ষকমণ্ডলী। তাদের কোমল মনে প্রিয় শিক্ষকদের কথাবার্তা, আদেশ-উপদেশ, আচার-আচরণ, শাস্তি-পুরস্কার ইত্যাদি এমনই অনপনেয় প্রভাব ফেলে যে, তাকে সারাটা জীবন বহন করে তার চেতন-অবচেতনে, চিন্তা ও কর্মে। এটা অপ্রিয় হলেও সত্য; বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের অধিকাংশ বাবা-মায়েরই সন্তানদের সঙ্গে সমৃদ্ধ সময় কাটানোর ফুরসত কিংবা সদিচ্ছা দুটোরই ভীষণ অভাব। বাবারা নিরন্তর ছুটছেন অর্থবিত্ত ও প্রতিষ্ঠার পেছনে। আর মায়েরা সংসারের ক্রমবর্ধমান চাহিদাগুলোর দাবি মেটাতেই গলদঘর্ম। অবসর যেটুকু জোটে তার সবটা খেয়ে নেয় টেলিভিশনের সস্তা বিনোদন কিংবা সামাজিক মাধ্যমের দুর্নিবার নেশা। এই সত্য থেকে আমরা এমন একটা সিদ্ধান্ত সহজেই টানতে পারি- শিশুদের মানস গঠনে এখন অভিভাবকের চাইতে শিক্ষকের ভূমিকা ও গুরুত্ব বেড়েছে অনেক গুণ।

এক্ষেত্রে অন্তত তিনটি বিষয়ে নিয়োগকর্তাদের যথেষ্ট যত্নবান ও মনোযোগী হওয়া দরকার। এক. নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মনমানসিকতায় বাঙালি, বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি বিষয়ে সত্যিকার অনুরাগ ও গর্ববোধ থাকতে হবে। দুই. তাদের বাংলাদেশের ইতিহাস, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এর যথার্থ চেতনা ও গুরুত্ব বিষয়ে যথাযথ ধারণা রাখতে হবে। তিন. তাদের পশ্চাৎপদ ভাবাদর্শের বিপরীতে যথাসম্ভব বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাবনার অনুসারী হতে হবে। এ বিষয়টি জরুরি ও গুরুত্ববাহী এ জন্য যে, আমাদের অজ্ঞতা ও অসতর্কতার সুযোগে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অনেক দিন ধরে মৌলবাদী গোষ্ঠী শিক্ষক নামধারী প্রচুর প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদ মানসিকতার মানুষজনের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এরা সজ্ঞানে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন গোড়া থেকেই বিষিয়ে তোলে নানাবিধ কুসংস্কার, ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা, সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষ ও বিজ্ঞানবিরোধিতার মতো অপবিশ্বাসের ক্ষতিকর সংক্রমণ ঘটিয়ে। ফলে সময় এসেছে আমরা আমাদের প্রাণপ্রিয় সন্তান ও দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের বুনিয়াদি শিক্ষার ভারটুকু কাদের হাতে তুলে দিচ্ছি, সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ও সাবধানী হওয়ার।

জানি, অনেকেই বলবেন, এটি একটি ইউটোপীয় প্রস্তাবনা। এত মানদণ্ডে উতরে যাওয়ার মতো শিক্ষক আমরা কোথায় পাব, তা-ও একেবারে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে! আর তাদের নির্বাচনী পরীক্ষা কিংবা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এ বিষয়টি নির্ধারণই বা করা হবে ঠিক কোন পদ্ধতিতে? তবে আমার বক্তব্য, আগে অন্তত এর গুরুত্ব ও প্রয়োজন তো স্বীকার করি। প্রথমেই হয়তো ষোলো আনা সাফল্য আসবে না। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, এবং তা অর্জনে যদি অবিচল থাকি, তাহলে আজ হোক কাল হোক সেটা অর্জিত হবেই। সর্ববিষয়ে না হোক অন্তত ভাষা, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সমাজপাঠের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উপর্যুক্ত মানদণ্ডের ওপর বাড়তি জোর দিলে অবশ্যই সুফল মিলতে বাধ্য। শিক্ষকদের নির্বাচনী পরীক্ষার লিখিত পর্বে যদি অন্যান্য প্রশ্নের পাশাপাশি দু-একটি সৃজনশীল ও রচনাধর্মী প্রশ্ন থাকে, যেখানে তাদের ভাষাজ্ঞান, সমাজভাবনা, বিজ্ঞানচিন্তা ও ইতিহাসবোধের কিছুটা প্রতিফলন ঘটবে, তাহলে সেটাও তাদের মানস কাঠামো যাচাইয়ের একটা প্রাথমিক মানদণ্ড হতে পারে। এর পর তো মৌখিক পরীক্ষার বিষয় রয়েছেই।

তবে এটাও ঠিক, সুষ্ঠুভাবে শিক্ষক নিয়োগই সবকিছু নয়। এর মাধ্যমে একটা প্রাথমিক ভিত্তি নির্মিত হতে পারে কেবল। এর পর আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় ও পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা এর সম্পূর্ণ সুফল পাওয়ার আশা করতে পারব। এক. নির্বাচিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। আমরা জানি, দেশে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নামে একটি জাতীয়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদানের সক্রিয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। আমরা যদি এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে একই সঙ্গে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি, তাহলে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত শিক্ষকরা নিজেরাও তাদের মৌখিক ও লিখিত ভাষাজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন; দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে সম্যক জ্ঞানলাভ; যুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতা; প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা; সর্বোপরি সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ে স্বচ্ছ ও সুন্দর চিন্তার সক্ষমতাও অর্জন করবেন। এবং এই মূল্যবান প্রশিক্ষণকে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে অব্যাহত রাখতে ও নিরন্তর হালনাগাদ করে যেতে হবে, যাতে সহজেই তাতে মরচে পড়তে না পারে। দ্বিতীয়. স্কুলে স্কুলে নিয়মিতভাবে পরিদর্শক পাঠিয়ে এটা নিশ্চিত করা- শিক্ষকরা তাদের ওপর অর্পিত গুরুদায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করছেন।

আরও একটি জিনিস খুব জরুরি। সেটি হচ্ছে, আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে বাইরের বই পড়ার অভ্যাসকে উৎসাহিত ও শিক্ষার্থীদের মানসভূমিতে তা আমূল প্রোথিত করে দেওয়া। এ জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ও একজন উপযুক্ত, নিষ্ঠাবান লাইব্রেরিয়ান থাকা অপরিহার্য। পাঠের পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চাকেও বেগবান করে তুলতে হবে বিদ্যালয়গুলোতে। বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক, বিতর্কচর্চা, দেয়ালপত্রিকা ও বার্ষিকী প্রকাশ, জাতীয় দিবসগুলো তো বটেই, গুরুত্বপূর্ণ মনীষী ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালন, উপযুক্ত উপলক্ষে মাঝেমধ্যে নানাবিধ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উৎসবের আয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা পরে শিশুদের প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ে আগ্রহী ও আকৃষ্ট করে তুলতে হবে, যেন তারা ইট-কাঠের ঘেরাটোপের মধ্যে যন্ত্রবৎ বড় না হয়ে পরিবেশের প্রতি সচেতন এবং আরেকটু মানবিক, দরদি ও দায়িত্ব্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। দেরিতে হলেও এ কাজটি আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে দ্রুত প্রবর্তন করা উচিত।

লেখক ও শিল্প সংগঠক