রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে হিসাবদিহিতা-জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার অপরিহার্যতার ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন অবশ্যই দুরূহ থেকে যাবে যদি এসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না যায়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে আমাদের জাতিগত কিংবা রাজনৈতিক কিছু সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। যে প্রত্যয়ে আমরা এই স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম; এর বাস্তবায়ন কি আজও সম্ভব হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয় অন্তহীন নয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ প্রশ্নটা করতেই পারি- একটি জাতির কাছে ৫০ বছর কি কম সময়? উত্তরটা হতে পারে- মহাকালের হিসাবের নিরিখে সময়টা বেশি নয়। কিন্তু আমাদের সামনে এমন অনেক দৃষ্টান্তই আছে, বিগত ৫০ বছরে বিশ্বের অনেক দেশই উন্নয়ন-অগ্রগতিতে ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অস্বীকার করা যাবে না, আমরাও বিগত ৫০ বছরে এগিয়েছি; উন্নয়ন-অগ্রগতির সড়ক আমাদেরও চওড়া কম নয়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত যাত্রার নিরিখে তা যে যথেষ্ট নয়- এ সত্যও মেনে নিতে হবে। আমাদের অনেক সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে। অনেক অর্জনের বিসর্জনও ঘটেছে এবং একটি দেশ ও জাতির জন্য দুর্নীতি নামক ব্যাধি সবচেয়ে যে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়, তা এখনও আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
সমগ্র বিশ্ব এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান করোনা-দুর্যোগ দেশে দেশে যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে; জীবন অধ্যায়ে ক্ষয়ের নানামুখী রেখা যেভাবে ক্রমাগত মোটা করে চলেছে, এর ভবিষ্যৎ ফল আরও কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তাতে শঙ্কিত ভবিতব্য। আমরাও এর বাইরে নই। করোনা মহামারি চরম মর্মন্তুদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। জীবন-জীবিকায় পড়েছে গাঢ় ছায়া। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দৃশ্যমান। এই দুর্যোগকালে অত্যন্ত বিস্ময়করভাবে সমান্তরালে আমাদের দেশে দৃশ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার নগ্ন চিত্র। আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর চিত্র তো বটেই; একই সঙ্গে নানা রকম অসংগতির পাশাপাশি এ খাতের সীমাহীন ব্যর্থতা, অদূরদর্শিতার মর্মস্পর্শী খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতে হয়েছে, হচ্ছে। দুর্যোগকালেও সংবাদমাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির উৎকট চিত্র উঠে আসছে। একের পর এক এবং বিস্ময়কর হলো, এত নেতিবাচক ঘটনার পরও এ খাতে দুর্নীতি চলছেই। লাগাম টানা যাচ্ছে না। ২৮ জুলাই ফের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের শীর্ষ প্রতিবেদনে প্রকাশ, ১৫টি হাসপাতালের নিরীক্ষাচিত্রে কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। জানা গেছে, বিগত দেড় বছরে করোনা-দুর্যোগকে পুঁজি করে এ খাতের অসাধুদের কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার ওপরে। অথচ প্রতিকার চিত্র বিবর্ণ। দেড় বছরেরও বেশি সময়ে অসাধুদের কোনো একজনেরও শাস্তি হলো না! দায়িত্বশীলদের বক্তব্য, প্রতিকার ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
এসব ঘটনা সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের হিসাবদিহিতা-জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার অভাবে সুস্পষ্ট নজির। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, বড় বড় দুর্নীতির পেছনে রাজনৈতিক অসাধু বলবানদের ছায়া থাকে। থাকে লোভ-লাভের দৃষ্টি। চুনোপুঁটি কিংবা রাঘববোয়াল যা-ই বলি না কেন, ওদের ঘাড়ে অনেক মাথা। আরও বলা দরকার, ওই মাথারও মাথা আছে এবং দুর্নীতির মচ্ছব এ কারণেই থামে না। আমরা জানি, সরকারি চাকরিবিধিতে নির্দিষ্ট সময়ান্তে দফায় দফায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়া এবং সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সিংহভাগই রয়েছেন এই বিধানের ঊর্ধ্বে- এই সংবাদ ফের সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠিয়ে বিধিমালা কার্যকর করার জন্য সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিলম্বিত এই বোধোদয়ের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু চিঠি পাঠানোই কি শেষ কথা? এর পরবর্তী কার্যক্রম কতটা গতিশীল হবে কিংবা থাকবে- এ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অভিজ্ঞতা প্রীতিকর নয়। এই চিঠির সঙ্গে বিদ্যমান হিসাব বিবরণী দাখিলের একটি ছক ফর্মও পাঠানো হয়েছে। ভালো উদ্যোগ। কিন্তু কোনো উদ্যোগেরই সুফল মিলবে না, যদি যথাযথভাবে বিধি কিংবা সরকারি নীতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া জোরালো না হয়। সুশাসন নিশ্চিত করার স্বার্থে এর বিকল্প নেই। প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা-শুদ্ধাচার-জবাবদিহিতার যে কথা বারবার বলা হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করতে এর কোনো বিকল্প নেই।

কেবল সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাই শুধু নন; রাজনীতিক, সরকারের নীতিনির্ধারক, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সব জনপ্রতিনিধির সম্পদের হিসাব নেওয়া জরুরি। এ বিষয়টি অতীতে বহুবার আলোচনায় এসেছে। সরকারের তরফেও এ ব্যাপারে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল। আমাদের স্মরণে আছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বলা হয়েছিল- মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সব জনপ্রতিনিধি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত ছাড়া আর কেউ জনসমক্ষে হিসাব দাখিল করেছিলেন বলে জানি না। নির্বাচনী ইশতেহার নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকারনামা কিংবা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দেশের প্রয়োজনে অপরিহার্য দলিল। অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত হলেও সত্য, এই অঙ্গীকারনামা কাগুজে দলিল হয়েই আছে এবং স্পষ্টত এও বলা যায়, এমনটি নির্বাচনী অঙ্গীকারের বরখেলাপ। জনগণের সঙ্গে উপহাসের শামিল। এ ধরনের হীনতৎপরতা অস্বচ্ছতার পরিধিই কেবল বিস্তৃত করে না, একই সঙ্গে অনাচার-দুরাচারের কারণে সৃষ্ট ক্রমাধারে ক্ষত সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। আমাদের সংবিধানেও এর সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা, রাজনীতির কর্ণধাররা এসব কোন এখতিয়ারবলে অমান্য করছেন- এ প্রশ্ন নাগরিক সমাজ থেকে উঠতেই পারে।
সুশাসন, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ইত্যাদি জনসম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে এ পর্যন্ত কথা অনেক হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কাজের কাজ হয়েছে এর চেয়ে অনেক কম। আবার এরই বিরূপ ফল হচ্ছে দৃশ্যমান নানা রকম কদাচার। আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যয় ভুলে গেছি? সমতাভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়ী হতে না পারলে আমরা কখনোই অকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারব না। এ ব্যর্থতা আমাদের নিয়তি হতে পারে না। অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার মূলোৎপাটন করতে হলে হাত দিতে হবে একেবারে উৎসে। উৎস অস্পর্শিত রেখে যে কোনো শুভ প্রত্যাশা একেবারেই দুরাশার নামান্তর। রাষ্ট্রের উচিত ভালো কাজের যথাযথ প্রতিদান দেওয়া, মন্দ কাজের কঠোর প্রতিকার নিশ্চিত করা। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিক কিংবা অন্য যে কোনো শ্রেণি-পেশার বলবানদের বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ ও সেকেন্ড হোমের বিষয়টি বহুল আলোচিত। এসব নিয়েও কথা এ পর্যন্ত কম হয়নি। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই। 'বেগমপাড়া' এরই একটি মাত্র খণ্ডিত দৃষ্টান্ত। বিদেশে অর্থ পাচারের নজিরও আমাদের সামনে কম নেই। সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এ সবকিছুর নিরসন ঘটানো দুরূহ নয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা