- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- একাত্তরের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও মুজিবনগর সরকার
বাংলাদেশের একাত্তর
একাত্তরের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও মুজিবনগর সরকার
ধারাবাহিক

পর্ব :২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডটি দেখলে বোঝা যায় যে, কত নানামুখী স্রোত ও শক্তি এসে মিশেছে মুজিবনগর সরকার গঠনে। সেখানে আন্তর্জাতিক, রাষ্ট্রীয়, বেসরকারি নানারকম সংস্থা এসে যুক্ত হচ্ছে, সহায়তা দিচ্ছে।
মুজিবনগর সরকারের মূল ভূমিকাটা কী ছিল? আমার মতে, মুজিবনগর সরকারের মূল ভূমিকাটি ছিল- 'এটি হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সরকার'- সারাবিশ্বের কাছে এই প্রতীকটি প্রতিষ্ঠা করা। এবং তারা আরেকটি বড় যে ভূমিকা পালন করছিল, সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা। একইসাথে তারা দেশের ভেতরে মানুষের কাছে যে সংবাদটি দিচ্ছিল- তার মাঝেও এই ধারণাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশের একটি সরকার আছে। তবে ঐ সরকার কতটা দুরবস্থার মধ্যে ছিল তার একটি উদাহরণ দিই-
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ একাত্তরে আফগানিস্তান হয়ে বিলেতে চলে গেলেন। এবং সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সাংগঠনিক কাজ করতে লাগলেন। এই সময় তিনি ইংরেজ মার্সেনারি বা ভাড়াটে সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পান। যারা মূলত অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। আফ্রিকায় এক সময় যারা খুব সক্রিয় ছিল। আবেদ সাহেব কয়েক হাজার পাউন্ড সংগ্রহ করে তাদের সাথে করাচি পোর্টটিকে উড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে পরিকল্পনা করার কথা ভাবলেন। তবে এই বিশাল ব্যাপারটি ঘটানোর আগে তিনি মুজিবনগর সরকারের অনুমতি নিয়ে নেয়ার জন্য তাজউদ্দীন আহমদের সাথে যোগাযোগ করলেন। তাজউদ্দীন সাহেবকে বললেন যে, আমি এ রকম একটা ব্যবস্থা করেছি। তারা করাচি পোর্টটা বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ তাকে বললেন, আপনি যে টাকাটা সংগ্রহ করেছেন, তা বরং আমাদেরকে দিয়ে দেন। কারণ আমি মুজিবনগর সরকারের খরচ চালাতে পারছি না। আমরা করাচি পোর্ট পরেও উড়াতে পারব; কিন্তু আমাকে তো আগে সরকারটা চালাতে হবে। এবং সত্যি সেই টাকাটা মার্সেনারিদের দিয়ে করাচি পোর্ট ধ্বংস করার পরিবর্তে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য সরবরাহ করা হয়েছিল। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, তখন কতটা তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে মুজিবনগর সরকার পরিচালিত হয়েছে।
ফজলে হাসান আবেদ বলেছিলেন, কী যে দুরবস্থার মধ্য দিয়ে মুজিবনগর সরকার চলত, তা চিন্তা করা যায় না। আমাকে সাক্ষাৎকারে তিনি এও বলেছিলেন যে, মুজিবনগর সরকারের বাজেটটা যদি দেখেন- তা দিয়ে এখনকার বাংলাদেশ তো বাদই দিলাম, তখনকার দিনের বাংলাদেশের মতো একটি দেশের সরকার পরিচালনা করার কথা ভাবাই যায় না।
আমি নিজেও মুজিবনগর সরকারের কোনো কোনো কর্মীর সাথে আলাপ করে যা বুঝেছি- তাদের কেউ কেউ অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চলত, কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের বাসায় থেকে কাজ চালাত। অর্থাৎ ভীষণ কষ্ট সহ্য করেও তখন এই সরকারটাকে রক্ষা করাটাই ছিল সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ভারত সরকারের। দুই সরকারের সঙ্গে যারা সম্পর্ক রক্ষা করত, তাদেরকে লিয়াজোঁ অফিসার বলা হতো। বিবিসির 'বাংলাদেশ একাত্তর' সিরিজের জন্য কাজ করার সময় এই লিয়াজোঁ অফিসারদের অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন এস কে রায়। উনি লিয়াজোঁ অফিসার ছিলেন মুজিবনগর সরকারের। আরেকজন ছিলেন অরুন্ধতী ঘোষ, যিনি পরে আন্তর্জাতিক কূটনীতিক হিসেবে কাজ করেছেন। এরা প্রত্যেকেই যে কথাটা বলেছিলেন, মুজিবনগর সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাদের দৃঢ়তা এবং সাহস।
মুজিবনগর সরকার সরাসরিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করত না। যুদ্ধ পরিচালনা করতেন সেক্টর কমান্ডাররাই। তবে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তারা। সেক্টর কমান্ডাররা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীন ছিলেন। যেহেতু তারা মাঠে-ময়দানে অবস্থা বুঝে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
অন্য যে বিষয়টা মুজিবনগর সরকার করতে পেরেছিল, তা হলো জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল। অর্থাৎ, প্রত্যেকটা এলাকাকে জোনে ভাগ করে সেই জোনগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয় পূর্বেকার আমলা-কর্মকর্তাদের হাতে। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখতেন। রাজনীতিবিদরা ছিলেন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য। এই জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলই যোগাযোগ রক্ষা করত সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে। অতএব সরকারি পর্যায়ের যে যোগাযোগ সমন্বয়, সেটা ছিল মাঠ পর্যায়ে। আর নিজেদের সার্বক্ষণিক অবস্থা বিবেচনা করে যুদ্ধটা অনেকটা নিজেদের সিদ্ধান্তে পরিচালনা করতেন আমাদের সেক্টর কমান্ডাররা।
যুদ্ধে দেশের ভেতরেও একাধিক সশস্ত্র শক্তি ছিল, যারা কোনোদিন ভারতে যায়নি প্রশিক্ষণ নিতে। যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত শক্তি হচ্ছে কাদেরিয়া বাহিনী। তাছাড়া হেমায়েত বাহিনী, অফসার বাহিনীসহ আরও অনেক বাহিনী ছিল মুক্তিযুদ্ধে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বেশ কিছু বামপন্থি শক্তি এ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তাদের মধ্যে আবার বেশ কয়েকটি ভাগ ছিল, যাদের অনেকে মুজিবনগর সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যুদ্ধে যুক্ত ছিল। আবার মুজিবনগর সরকারবিরোধী বামপন্থিরাও ছিল। তারাও কিন্তু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। অর্থাৎ, বাংলাদেশ একাত্তরে কোনো সরলরৈখিক বিবরণ নয়। এর বহুমাত্রিকতা ছড়িয়ে রয়েছে এর সবগুলো ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য বা অন্যান্য কাজে ওপারে যেত- শরণার্থী শিবিরে রিসেপশন ক্যাম্পে যেত। এবং তারপরে সেখান থেকে ট্রেনিং ক্যাম্পে যেত। যুবকদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্বটা ছিল মুজিবনগর সরকারের। ইউসুফ আলী এমএনএ ছিলেন এই দায়িত্বে। মুজিবনগর সরকারের অধীনে ইউথ বোর্ড নামে তার একটা সংস্থা ছিল, তার মাধ্যমেই এই কাজটি পরিচালিত হতো। যারা মুক্তিযুদ্ধে যেত, প্রথম পর্যায়ে মুজিবনগর সরকার তাদেরকে একটা ফিল্টারিং করত। তারপরে গ্রহণযোগ্য মনে হলে তাদেরকেই কেবল যুদ্ধে পাঠানো হতো। ভারত সরকার এবং মুজিবনগর সরকার উভয়েরই দুশ্চিন্তার ব্যাপার ছিল যে, পাকিস্তানি বাহিনীর কেউ যাতে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়তে না পারে। এটি মুজিবনগর সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। রাজনীতিবিদরাও এ কাজে অংশ নিয়েছেন। তারাও ট্রেনিং নিতে আসা মানুষদের ভেটিং করত- যাতে করে অপরিচিত বা সন্দেহজনক কেউ ঢুকে পড়তে না পারে। একাত্তর সালে এটিও আমাদের একটি বাস্তবতা।
একাত্তরের যুদ্ধে অন্য যে বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ- সেটি হলো শরণার্থী। ভারতের শরণার্থী শিবিরে বাংলাদেশের কতজন মানুষ গিয়েছিল তা নিশ্চিত করে আমরা বলতে না পারলেও জানি যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ শরণার্থী হয়েছিল। এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে সামলেছিল মূলত ভারত সরকার। তবে এর সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের অংশগ্রহণটা ছিল। বাংলাদেশের এই মানুষদের সামলানোর জন্য ভারত সরকার আলাদা একটি বিভাগ তৈরি করে ফেলেছিল, যাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকার। এটি মুজিবনগর সরকারের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি কাজ ছিল কিছু কিছু স্বাধীন এলাকা বা মুক্তাঞ্চল থেকে খাজনা আদায় করা। এটি অনেকটা প্রতীকী হলেও এর গুরুত্ব ছিল অসীম। আর একটি বড় পরিসর ছিল আন্তর্জাতিকভাবে যেসব বাঙালি প্রবাসী বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা। বিশেষ করে ইউরোপ, বিলেত এবং আমেরিকায় যে আন্দোলনটা সংগঠিত হয়েছিল, তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগটা রাখত মুজিবনগর সরকার।
আমরা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কথা জানি- তিনি মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টার মতো কাজ করেছিলেন। তিনি বিলেতে বিশাল আন্দোলন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। গুরুত্বের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনটিও ছিল উল্লেখযোগ্য। সেখানে উল্লেখযোগ্য হারে মার্কিনিরাও সরাসরি যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ৫০ বছর আগের তথ্য-প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার সময়েও মুজিবনগর সরকার এই আন্তর্জাতিক আন্দোলনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পেরেছিল।
মুজিবনগর সরকারের তীব্র অর্থ সংকট ছিল। কোনো টাকা-পয়সা ছিল না তহবিলে। তবু এমন উদাহরণও আছে যে, অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ পেয়েও তারা সে সুযোগ গ্রহণও করেনি। সেটা হচ্ছে ইজরাইলের লবি। ইজরাইলের লবিস্টরা খুব চেষ্টা করেছিল সাহায্য করতে। আমাদের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মাধ্যমেও তারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল বলে শুনেছি। অন্য আরেকজন ছিলেন চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির। তার সাথেও ইজরাইলি লবিস্টরা যোগাযোগ করেছিল বলে শোনা যায়। তারা সরাসরিভাবে মুজিবনগর সরকারকে বিষয়টি জানিয়ে দেন এবং মুজিবনগর সরকারও তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিল। এমনকি ইজরাইলপন্থি সাংবাদিকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সমর্থন সহায়তা করে থাকলেও মুজিবনগর সরকার নীতিগতভাবেই ইজরাইল থেকে দূরে ছিল। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের বিরাট অংশ পাকিস্তানপন্থি ছিল এবং আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল। তারপরেও মুজিবনগর সরকার ইজরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সুতরাং দেখা যায় যে এই দূরদর্শিতাটা মুজিবনগর সরকার এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের ছিল।
২০০০ সালের দিকে এস কে রায়ের সঙ্গে আমার যখন আলাপ হয়, তখন তিনিও আমাকে বলেছিলেন যে, কেনেডি যখন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করেন, তিনি তাজউদ্দীন আহমদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে সাংঘাতিক রকমের প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ এত সহজ-সরল অথচ বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্বটা দিয়েছিলেন! বাইরের শক্তিগুলো তো ছিলই, একই সময়ে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভেতরকার বিরোধী শক্তিগুলোও কাজ করছিল। কিন্তু রাজনীতি এবং রাজনীতির বাইরের এই বহুবিধ বিরোধী শক্তিকে মোকাবেলা করেই মুজিবনগর সরকারকে কাজ করতে হয়েছে। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হলো, মুজিবনগর সরকারের সবচেয়ে বড় যে অস্তিত্ব অর্থাৎ বাংলাদেশ- সেটার ওপরই তার কর্তৃত্ব ছিল না। বাংলাদেশের মানুষ তো আর মুজিবনগর সরকারের অধীনে ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান সরকারেরও অধীনে ছিল না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এক পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, অন্য পক্ষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক না থাকলেও তার তার প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছে। অর্থাৎ, যে যুদ্ধটার নেতৃত্ব দিচ্ছে মুজিবনগর সরকার, সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। এটাই একাত্তরের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা ছিল।
এখানে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। সেটি হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মানুষের কাছে এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল মুজিবনগর সরকারের একটি প্রতীকী কণ্ঠ। যাদের কাছে রেডিও ছিল কিংবা প্রতিবেশী নিকটজনদের কাছে ছিল- তারা প্রতিদিন উদগ্রীব হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনেছে। এর কারণ হচ্ছে তারা তখন নিজের দেশের কথা শুনছিল। কেবল উপস্থিত থাকলেই যে দেশ উপস্থিত থাকে তা না, উপস্থিত না থেকেও উপস্থিত থাকা যায়। একাত্তর সালে সরকার অত্যন্ত সরবভাবে প্রতিটি গ্রামে-শহরে উপস্থিত ছিল। যেখানেই রেডিও ছিল, সেখানেই তারা ছিল এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে। যেটি ছিল মুজিবনগর সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান। তার ভূমিকাটিকে এখন আমরা কেবল গণমাধ্যমের আদলে দেখছি, কিন্তু একটি রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে যে এটা ভূমিকা পালন করেছে- সেই দিকটা আমরা ততটা লক্ষ্য করি না।
একাত্তরের মার্চ মাস থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সরকার উভয়ই আগাচ্ছে, সে ধারাবাহিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক হতে গিয়ে সে বিদেশের মাটিতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। দেশের মধ্যে থেকে সে তখনও প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করতে পারেনি। একাত্তরের মার্চ আর মুজিবনগরের মাঝে এটাই হচ্ছে পার্থক্য। শেষ পর্যন্ত গিয়ে যেটা দাঁড়াচ্ছে- যখন দেশ স্বাধীন হচ্ছে, মুজিবনগর সরকার যখন ঢাকায় আসছে, তারপর থেকে আমরা বলতে পারি যে বাংলাদেশ সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়টা শুরু হচ্ছে নিজের মাটিতে। শেখ মুজিবুর রহমান ফেরত আসার পর তা আরও বেশি করে প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে ধাবিত হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
এই ধারাবহিকতায় যদি লক্ষ্য করা হয়- দেখা যাবে যে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের যে চরিত্র, মুজিবনগর সরকারও সেই চরিত্রই ধারণ করেছিল। এবং উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষের ভূমিকাটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষ যদি মুজিবনগর সরকারের প্রতি সমর্থনশীল না হতো, তাহলে মুজিবনগর সরকার টিকতোও না, কেউ তাকে সমর্থনও করত না। তারা কলকাতাতেই থেকে যেত।
ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি আমাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে নভেম্বরের দিকে ইন্দিরা গান্ধী তাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে তাদের মনোভাব সম্পর্কে জেনে আসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তিনি বহু জায়গায় গিয়েছেন এবং সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছিল- বাংলাদেশ যে হবে এটা আমরা আগে থেকেই জানি। কিন্তু তোমরা পাকিস্তানকে দখল কোরো না।
অর্থাৎ, ২৫শে মার্চের পরে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছিল পাকিস্তান এবং পাকিস্তানপন্থি কিছু দেশ ছাড়া আর কেউ না। এবং সেই বাস্তবতার স্রোতটাকে ধরে রাখার দায়িত্বটাই পালন করেছিল মুজিবনগর সরকার।
[এই প্রসঙ্গ সমাপ্ত]
মন্তব্য করুন