কেবল ভাগ্য বদলের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ বিদেশের মাটিতে কাজের সন্ধানে গমন করেন। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে বাংলাদেশের কর্মীরা কাজ করছেন না। সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও আমাদের তরুণদের কর্মসংস্থান শুরু হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশেরই নির্মাণ, পর্যটনশিল্পসহ কলকারখানা সচল রেখেছে আমাদের জনশক্তি। তাদের হৃদয় নিংড়ানো শ্রমের ছাপ রয়েছে পৃথিবীর বহু দেশকে সমৃদ্ধিশালী করতে। আশির দশক থেকে শুরু করে আমাদের অভিবাসীদের ভাগ্য বদলের গল্প এখনও অব্যাহত রয়েছে, যা আমাদের বিমোহিত করে। বছরের পর বছর প্রিয় স্বদেশভূমি ছেড়ে বিদেশে অবস্থানরত আমাদের তরুণ-তরুণীদের শ্রমের-ঘামের সাফল্যের গল্পের কোনো শেষ নেই। আজকে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে বিস্ময়কর রূপান্তর ঘটছে তাতে জনশক্তি খাত এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্কই বটে।

অভিবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশে না এলে, রেমিট্যান্স প্রবাহ গতিময় না থাকলে আমাদের অর্থনীতির ম্যাড়মেড়ে আওয়াজ পাওয়া যায়, যা আমরা করোনার সময় হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। জনশক্তি রপ্তানি খাত আমাদের সব দুর্ভোগ-দুর্যোগকে আগলে রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। এটি অর্থনীতির এক 'ম্যাজিক' খাত। কিন্তু যে খাতে এত এত সাফল্য সেই খাতের নির্মাতাদের আমরা কতটা সুরক্ষা করতে পারছি, কতটা মর্যাদা দিতে পারছি- এটি এখন বড় এক প্রশ্ন। বাংলাদেশের জনশক্তির বাজারকে বিস্তৃত করতে বেসরকারি জনশক্তি প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যুগ যুগ ধরে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মূল্যায়ন ও মর্যাদার প্রশ্নে জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বারবার হোঁচট খাচ্ছেন। মর্যাদার লড়াইয়ে দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরাখ্যাত জনশক্তি প্রেরণকারীদের সাফল্যের গল্প তেমনভাবে কোথাও উপস্থাপিত হয় না। অথচ গণমাধ্যমে এনজিও বা উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিদিনই কত না তথাকথিত সাফল্যের কেস স্টাডি আমরা দেখতে পাই। অথচ আমরা খুব কমই দেখতে পাই, হাজার হাজার নারী, যারা সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিনা খরচে গিয়ে পারিবারিক দরিদ্রতা দূর করেছেন। নিজের আয়কৃত অর্থ দিয়ে নতুন ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে সঞ্চয় করেছেন। সেই নারীকর্মী সালেহা, রাবেয়া কিংবা রহিমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প খুব একটা গণমাধ্যমে আসে না। জনশক্তি প্রেরণ খাতের নির্মাতাদের একটা বড় দুঃখ- আজকে যে লাখ লাখ বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, অসচ্ছল নারী তাদের মাধ্যমে বিনা খরচে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন, সেই সফলতার গল্প খুব কমই চোখে পড়ে।

মর্যাদার প্রশ্নে এই খাত সেই অর্থে তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। এই খাতের উদ্যোক্তাদের নেতিবাচক উপস্থাপন তেমন দেখা না গেলেও আইনের মারপ্যাঁচে এই খাতের বৈধ উদ্যোক্তাদের পথ চলায় হোঁচট খেতে হয়, যা এই খাতকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সৎ উদ্যোক্তারাও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। সমাধানযোগ্য সমস্যার সমাধানের পথ না খুঁজে জটিলতা তৈরির মাধ্যমে মানব পাচার আইনের মামলায় আসামি হচ্ছেন অনেকে। হাজতবাস খাটছেন। জেল জরিমানার শিকার হচ্ছেন। রিক্রুটিং এজেন্সিরা বলছে, বৈধভাবে অভিবাসন আইন মেনে কর্মী পাঠানো আর মানব পাচার এক নয়। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, নিরাপদ কর্মসংস্থান, ন্যায়সংগত অভিবাসন, অভিবাসী কর্মী ও তার পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩ করা হয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় নিজের ভুলে দেশে ফিরে এসে কর্মীরা রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ তুলছে। অথচ বিদেশ থেকে ফিরে আসা সেই কর্মীকে রিক্রুটিং এজেন্সি সংশ্নিষ্ট দূতাবাসের সত্যায়ন, নিয়োগ অনুমতি, ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স, বিএমইটি স্মার্টকার্ডসহ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সব প্রক্রিয়া শেষ করে বিদেশে পাঠিয়েছে। তার পরও সেই বিদেশফেরত অভিযোগকারীর অভিযোগকে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩ মাধ্যমে সমাধান না করে মানব পাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২ এ মামলা নেওয়া হচ্ছে। অথচ ১৯৮২ সালের ইমিগ্রেশন অর্ডিন্যান্স রহিত করে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ২০১৩ সালে শ্রম ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক অন্যান্য সনদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে নতুন এই অভিবাসী আইনটি করা হয়। এই আইনের ধারা ও উপধারাতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ্য করা আছে কী কী বিষয়ের ব্যত্যয় ঘটলে কোন রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করা, বাতিল করা, ফৌজদারি আইনে দণ্ড প্রদান  যেতে পারে।

অনেক মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, সভা, সেমিনার করে বিষয়টি রিক্রুটিং এজেন্সির উদ্যোক্তারা সরকারের নজরে আনতে সমর্থ হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২১ অক্টোবর এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের মানব পাচার আইনে হয়রানি না করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তিনি কারও বিরুদ্ধে কোনো থানায় অভিযোগ এলে অধিকতর তদন্তের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স দেওয়া প্রতিষ্ঠান জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোকে (বিএমইটি) হস্তান্তর করার কথা উল্লেখ করেন। বিএমইটি অভিযোগটি নিষ্পত্তিযোগ্য মনে না করলে অভিযোগের ধরন বুঝে মানব পাচার অথবা অভিবাসন আইনে মামলা করা যাবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ওই সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও পররাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিএমইটির মহাপরিচালকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ওই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সুপারিশ বা নির্দেশনা নিয়ে লিখিত কোনো পত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এখনও দেওয়া হয়নি। আমরা আশা করি, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অভিভাবক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের একটা পথ বের করবেন। তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়, একজন সমাজ চিন্তক মানবিক মানুষ হিসেবে তিনি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এই সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন। তবে এই কথা মনে রাখতে হবে, বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির আড়ালে কেউ যদি বিদেশে কর্মী পাঠানোর নামে কাউকে হয়রানি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশ পাঠায় তাহলে তাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে।

তবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মর্যাদা বৃদ্ধি বা গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) এর দায় এড়াতে পারে না। এই সংগঠনের মধ্যে বহু দল-উপদল তৈরি হয়েছে, যারা সব সময় পরনিন্দা করে থাকে। কখনোই আয়নায় নিজের মুখ দেখে ভাবে না এত বড় একটা সংগঠনের জন্য দায়িত্বকালীন সদস্যদের কল্যাণে কিছু করেছে কিনা? নাকি বায়রাকে ব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। তবে তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, যারা নিজের আখের ঘোচানোর জন্য বায়রার নেতৃত্ব দিতে চায় তারা যদি একটা ঐক্যবদ্ধ বায়রা গড়ে তুলতে না পারে, তাহলে সাধারণ সদস্যরা সেই নেতৃত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে মজবুত করতে নিজেদের আন্তঃকোন্দল পরিহার করে প্রবাসী আয়ের এই খাতকে আরও বেশি গতিশীল করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের যে পদযাত্রায় রয়েছে, তার অংশীজন হিসেবে শক্তিশালী কোন্দলহীন বায়রা এখন সময়ের দাবি।

সবশেষে বলব, আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার আরও অনেক বড় হবে। এ কারণেই আমাদের জনশক্তি বাজার আরও বেশি প্রসারে বিকল্প নেই। এ বছরের যে বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী, সেখানে শিরোনামে বলা হয়, 'জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ'। জনশক্তি খাত এ দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবিকার খাত। এই খাতকে যারা টেনে সামনের দিকে নিয়ে যায় তারা হলো, জনশক্তি রপ্তানিকারক তথা রিক্রুটিং এজেন্সি। যারা সরকারের কাছ থেকে বৈধ লাইসেন্স নিয়ে, বৈধ আইন-কানুন অনুসরণ করে বিদেশে কর্মী পাঠিয়ে থাকে। তাই সেই নির্মাতা, সেই উদ্যোক্তা রিক্রুটিং এজেন্সির চলার পথ আরও মসৃণ করা প্রয়োজন। তাদের সুরক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মানব পাচারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে জনশক্তি প্রেরণ খাতকে এগিয়ে নিয়ে প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে সংশ্নিষ্ট সবার সহযোগিতা অপরিহার্য।

 শ্রম অভিবাসন বিশ্নেষক ও চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com