
কয়েক বছর আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম, মজুদ থাকা সত্ত্বেও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার তো কারণ দেখি না। তো তত্ত্ব দিয়ে নানা হিসাব দেওয়ার পর শেষে অফ দ্য রেকর্ড বললেন, দেখ, যতই দাম বাড়ূক, তুমি কিন্তু অল্প-বেশি যাই হোক কিনছ। না কিনে কি বাজার থেকে ফেরত এসেছ? দোকানির পণ্য কি নষ্ট হয়েছে? কেউ রাস্তায় নেমেছে?
ঘটনা কিন্তু সত্যি! কেউ রাস্তায় নামেনি। দোকানির পণ্যও নষ্ট হয়নি। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, চায়ের টেবিলে অনেক ঝড় বইছে, কিন্তু বাজারে যাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে অনেকেই বলতে পারেন, খাওয়ার পরিমাণ বা মান কমেছে। সেটি আরেক তর্কের বিষয়।
বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে ব্যবসায়ী ও সরকার আলোচনা করে নতুন বাড়তি দাম বেঁধে দেয়। মিটিং-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে গতানুগতিক কিছু কথা- আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে বা উৎপাদন কম হয়েছে অথবা সরবরাহ ঠিকমতো হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে, উৎপাদন ভালো হলে কিংবা সরবরাহ ঠিক থাকলেও কোনোদিন দেশের বাজারে তা কমতে দেখা যায়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাজার মনিটর করে একটি টিম। সেই টিম তাৎক্ষণিক কিছু জরিমানা করে চলে যায়। এতটুকুই যদি হয় শাস্তি, তাহলে প্রতিদিনই বিক্রির কিছু অংশ তো ব্যবসায়ীরা জরিমানা হিসেবে দিতেই পারে! বাজারের আসল চিত্র কী? মনিটরিং টিম কী দেখে- মূল্য তালিকা টানানো আছে কিনা এবং সে অনুযায়ী পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা। অথচ সবাই জানে, মনিটরিং টিম আসার খবরে মূল্য তালিকা উন্মুক্ত হয়। বাজারে টিম যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সব ঠিকঠাক চলে। মনিটরিং টিম চলে গেলে কোথায় তালিকা আর কোথায় সে অনুযায়ী দাম রাখা! মান্ধাতার আমলের এই তামাশা চলছে সবার গোচরে। অথচ ক্রেতা যদি সোচ্চার হতো তাহলে অনেক কিছু হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যেত।
করোনা মহামারির দীর্ঘ ১৮/১৯ মাসের স্থবিরতা শেষে সবকিছু সচল হওয়া শুরু করেছে। প্যান্ডেমিক থেকে সবাই এখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদকরা উৎপাদন শুরু করছেন। সরবরাহ ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি সচল হয়নি। উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। তবে প্রতিটি খাত ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সওয়ার হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাঁধে। মাত্র দুই কাঁধে সব খাতের বোঝা টানতে গিয়ে কোমর ভেঙে যাওয়ার উপক্রম এখন সাধারণ মানুষের।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) বলছে, করোনা মহামারিতে নতুন করে আরও দুই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন বেকার হয়েছে। নানা রকম হতাশার সঙ্গে সাধারণ ডাল-ভাতের নিশ্চয়তাও যদি না থাকে, তাহলে এত উন্নয়ন মানুষ কোথায় রাখবে?
গত কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্টম্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী। শতকরা হিসাবে যে কোনো পণ্যই একশ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, মূল্যস্ম্ফীতির হার যত শতাংশ হবে তত টাকা দিয়ে আপনাকে কিনতে হবে। অর্থাৎ কোনো পণ্যের দাম ১০ টাকা হলে সেই একই পণ্য শতকরা হিসাবে কিনতে হবে ১১০ টাকায়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত সেপ্টেম্বর মাসের হিসাবে বলা হয়েছে, মূল্যস্ম্ফীতির হার এখন সাড়ে ৫ শতাংশ। এটি ১২ মাসের গড় হিসাব। আর পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে এই হার ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। চলতি বছরের বাজেটে মূল্যস্ম্ফীতি ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাজারে গেলে ক্রেতাকে বেশি টাকায় কম পণ্য কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ একশ টাকা দিয়ে আগে যা কিনতেন, এখন ১১০ টাকা দিয়ে তা কিনতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, চলতি নভেম্বর মাসেই চালের দাম বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি, ময়দা সাড়ে ১৫ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেল ৪৬ শতাংশের বেশি, আলু ৪১ শতাংশের বেশি, চিনি ২৪ শতাংশ আর ডিমের দর বেড়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।
দুটো বড় সংস্থার হিসাবেই গরমিল। একদিকে বিবিএস এখনও পরিসংখ্যান হালনাগাদ করেনি। অন্যদিকে, বাজারের চিত্র ঊর্ধ্বমুখী। এই গোলমেলে হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেক মহল। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, বাজারের সঙ্গে সরকারের হিসাব মিলছে না। এর মধ্যে নতুন করে যোগ হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম, সঙ্গে পরিবহন খরচ।
আগেই বলেছি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতানুগতিক যুক্তি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজার, সরবরাহ ব্যবস্থা, উৎপাদন কমে যাওয়া। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে, অন্যান্য দেশের সরকার মাথাপিছু আয় হিসাব করে পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পণ্যের দাম সমন্বয় করে চলেছে। কিন্তু আমাদের দেশে কী হচ্ছে? আমরা নাকি রাত পোহালেই বড় লোক হয়ে যাই! বুঝতেই পারি না! আসলে বড় লোক হওয়ার প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে না। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমেই শুধু হা-হুতাশ চলছে, বাকি তো সব ঠিকই আছে! একটি অনন্য দেশ, যে দেশে প্রতিনিয়ত মানুষের দাম কমছে!
উন্নয়নকর্মী
মন্তব্য করুন